১০টি বনজ গাছ ও তাদের ঔষধি গুণাগুণ ও ব্যবহার
✨ ভূমিকা
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করে এসেছে। বিশেষত, বনজ গাছগুলোর পাতা, ছাল, মূল ও ফল ঔষধি গুণে ভরপুর। এই গাছগুলো শুধু বনভূমির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না, বরং আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই ব্লগে আমরা এমন ১০টি বনজ গাছের বিস্তারিত আলোচনা করবো যেগুলো আমাদের পরিবেশে সহজলভ্য এবং যাদের রয়েছে অসাধারণ ঔষধি গুণাগুণ। প্রতিটি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম, ঔষধি অংশ, রোগ প্রতিকার, ব্যবহারের পদ্ধতি ও সতর্কতা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
🌳 ১. গাছ: অর্জুন (Arjuna)

- বৈজ্ঞানিক নাম: Terminalia arjuna
- পরিবার: Combretaceae
ঔষধি গুণাগুণ:
- হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
- রক্ত পরিশোধক
- কফ ও হাঁপানিতে কার্যকর
ব্যবহৃত অংশ:
ছাল, পাতা
ব্যবহারের পদ্ধতি:
- অর্জুনের শুকনো ছাল গুঁড়ো করে দিনে ২ বার গরম পানিতে মিশিয়ে খাওয়া যায়।
- হার্টের টনিক হিসেবে অর্জুন ছাল সিদ্ধ জল পান করা হয়।
রোগে ব্যবহার:
| রোগ | ব্যবহারের ধরন | পরিমাণ |
|---|---|---|
| উচ্চ রক্তচাপ | ছালের রস | ৫-১০ মি.লি |
| হৃদরোগ | ছাল সিদ্ধ জল | দিনে ২ বার |
| কফ | ছালের গুঁড়া | মধুর সাথে |
সতর্কতা:
- গর্ভবতী নারীদের ব্যবহার নিষেধ।
- দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন।
🌲 ২. বহেড়া (Baheda)

- বৈজ্ঞানিক নাম: Terminalia bellirica
- পরিবার: Combretaceae
ঔষধি গুণাগুণ:
- ত্রিফলার একটি উপাদান
- হজমে সহায়ক
- ব্রণ ও ত্বকের রোগে উপকারী
- চুলের জন্য ভালো
ব্যবহৃত অংশ:
ফল, বীজ
ব্যবহারের পদ্ধতি:
- শুকনো ফল গুঁড়া করে সকালে খালি পেটে গ্রহণ।
- ত্রিফলা হিসেবে আমলকি ও হরীতকির সাথে মিশিয়ে ব্যবহার।
রোগে ব্যবহার:
| রোগ | ব্যবহার | পরিমাণ |
|---|---|---|
| কোষ্ঠকাঠিন্য | ফল গুঁড়া | ১ চা চামচ |
| চুলপড়া | তেল তৈরি করে | সাপ্তাহে ২ দিন |
| ব্রণ | গুঁড়া + মধু | মুখে মাস্ক |
সতর্কতা:
- বেশি মাত্রায় ব্যবহারে পেটের গন্ডগোল হতে পারে।
🌴 ৩. নিম (Neem)

- বৈজ্ঞানিক নাম: Azadirachta indica
- পরিবার: Meliaceae
ঔষধি গুণাগুণ:
- অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল
- অ্যান্টিফাঙ্গাল
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
- ত্বকের রোগের চিকিৎসায় কার্যকর
ব্যবহৃত অংশ:
পাতা, ছাল, বীজ, তেল
ব্যবহারের পদ্ধতি:
- নিমের পাতা সিদ্ধ করে গোসল।
- নিম তেল লাগালে চুলকানি ও ফাঙ্গাস দূর হয়।
- নিমপাতার রস খেলে রক্ত বিশুদ্ধ হয়।
রোগে ব্যবহার:
| রোগ | ব্যবহার | পরিমাণ |
|---|---|---|
| ত্বকের সমস্যা | পাতা সিদ্ধ জল | প্রতিদিন |
| ডায়াবেটিস | পাতার রস | ৫-১০ মি.লি |
| মুখে ব্রণ | নিম পেস্ট | দিনে ১ বার |
সতর্কতা:
- নিম রস বেশি খেলে যকৃতের উপর চাপ পড়ে।
🌿 ৪. গুলঞ্চ (Gulancha Tinospora)

- বৈজ্ঞানিক নাম: Tinospora cordifolia
- পরিবার: Menispermaceae
ঔষধি গুণাগুণ:
- রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
- জ্বর নিরাময়ে কার্যকর
- হজমে সহায়ক
- অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট
ব্যবহৃত অংশ:
লতা, পাতা
ব্যবহারের পদ্ধতি:
- লতার রস সকালে খালি পেটে খেলে জ্বর ও সর্দি উপশম হয়।
- গুলঞ্চের লতা ও পাতার পেস্ট তৈরি করে ত্বকে লাগানো হয়।
রোগে ব্যবহার:
| রোগ | ব্যবহার | পরিমাণ |
|---|---|---|
| টাইফয়েড | লতার রস | দিনে ২ বার |
| জ্বর | সিদ্ধ জল | দিনে ৩ বার |
| অ্যালার্জি | পেস্ট | ত্বকে লাগানো |
সতর্কতা:
- অতিরিক্ত ব্যবহারে পেট খারাপ হতে পারে।
- শিশুদের জন্য রসের মাত্রা অর্ধেক।
🌳 ৫. হরীতকী (Haritaki)

- বৈজ্ঞানিক নাম: Terminalia chebula
- পরিবার: Combretaceae
ঔষধি গুণাগুণ:
- হজমে সহায়ক
- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
- স্নায়ু শক্তি বৃদ্ধি করে
- চোখের সমস্যা কমায়
ব্যবহৃত অংশ:
ফল, বীজ
ব্যবহারের পদ্ধতি:
- শুকনো ফল গুঁড়ো করে রাতে পানির সাথে গ্রহণ।
- চোখে জ্বালাপোড়ায় হালকা গুঁড়ো ঠান্ডা জলে গুলে ব্যবহার।
রোগে ব্যবহার:
| রোগ | ব্যবহার | পরিমাণ |
|---|---|---|
| কোষ্ঠকাঠিন্য | ফল গুঁড়া | ১ চা চামচ |
| চোখের অস্বস্তি | ঠান্ডা জল | দিনে ২ বার |
| হজমে সমস্যা | পেস্ট | খাবারের পরে |
সতর্কতা:
- গর্ভবতী ও উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্তদের পরামর্শ নিয়ে গ্রহণ করা উচিত।
🌿 ৬. কালমেঘ (Kalmegh)

- বৈজ্ঞানিক নাম: Andrographis paniculata
- পরিবার: Acanthaceae
ঔষধি গুণাগুণ:
- লিভারের টনিক
- অ্যান্টি-ভাইরাল ও অ্যান্টি-ম্যালেরিয়াল
- ইনফেকশন প্রতিরোধ
- জন্ডিস নিরাময়ে কার্যকর
ব্যবহৃত অংশ:
পাতা, কাণ্ড
ব্যবহারের পদ্ধতি:
- পাতার রস খেলে লিভারের কার্যকারিতা ভালো হয়।
- কাঁচা পাতার পেস্ট জন্ডিসে ভালো ফল দেয়।
রোগে ব্যবহার:
| রোগ | ব্যবহার | পরিমাণ |
|---|---|---|
| লিভার সমস্যা | পাতার রস | দিনে ২ বার |
| ইনফেকশন | পেস্ট | ত্বকে ব্যবহার |
| জন্ডিস | সিদ্ধ পাতা | দিনে ২ বার |
সতর্কতা:
- তিক্ত স্বাদের কারণে অনেকের অরুচি হতে পারে।
- উচ্চমাত্রায় খেলে রক্তচাপ হ্রাস হতে পারে।
🌱 ৭. তুলসী (Tulsi)

- বৈজ্ঞানিক নাম: Ocimum sanctum
- পরিবার: Lamiaceae
ঔষধি গুণাগুণ:
- ঠান্ডা, কাশি ও জ্বরে উপকারী
- মানসিক চাপ কমায়
- সংক্রমণ রোধ করে
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
ব্যবহৃত অংশ:
পাতা, ফুল
ব্যবহারের পদ্ধতি:
- তুলসী পাতা চিবিয়ে খাওয়া যায়।
- পাতার রস মধুর সঙ্গে মিশিয়ে কাশিতে ব্যবহার হয়।
- তুলসী চা করে খাওয়া যায়।
রোগে ব্যবহার:
| রোগ | ব্যবহার | পরিমাণ |
|---|---|---|
| কাশি | পাতার রস + মধু | দিনে ৩ বার |
| ঠান্ডা | তুলসী চা | দিনে ২ বার |
| জ্বর | পাতা সিদ্ধ জল | দিনে ২ বার |
সতর্কতা:
- বেশি পাতা খেলে পেটের সমস্যা হতে পারে।
🌿 ৮. বাসক (Bashok)

- বৈজ্ঞানিক নাম: Justicia adhatoda
- পরিবার: Acanthaceae
ঔষধি গুণাগুণ:
- কাশি ও হাঁপানির প্রাকৃতিক ওষুধ
- শ্বাসতন্ত্র পরিষ্কার করে
- রক্ত পরিষ্কার করে
- জ্বর নিরাময় করে
ব্যবহৃত অংশ:
পাতা, ফুল, মূল
ব্যবহারের পদ্ধতি:
- বাসকের পাতা সিদ্ধ করে জল পান করা যায়।
- পাতার রস মধুর সঙ্গে মিশিয়ে কাশির জন্য খাওয়া হয়।
- শুকনো পাতা পিষে গুঁড়া করেও ব্যবহার করা যায়।
রোগে ব্যবহার:
| রোগ | ব্যবহার | পরিমাণ |
|---|---|---|
| কাশি | পাতার রস + মধু | দিনে ২-৩ বার |
| হাঁপানি | সিদ্ধ জল | সকালে ও রাতে |
| ত্বকের সমস্যা | পাতা পেস্ট | প্রয়োজনে |
সতর্কতা:
- গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পরামর্শসাপেক্ষে ব্যবহার।
- দীর্ঘমেয়াদে না খাওয়াই ভালো।
🌿 ৯. শতমূলি (Shatamuli)

- বৈজ্ঞানিক নাম: Asparagus racemosus
- পরিবার: Asparagaceae
ঔষধি গুণাগুণ:
- স্ত্রী রোগে উপকারী
- হরমোন ব্যালান্স করে
- দুধ বাড়াতে সাহায্য করে
- দুর্বলতা দূর করে
ব্যবহৃত অংশ:
মূল (জড়)
ব্যবহারের পদ্ধতি:
- শতমূলির মূল শুকিয়ে গুঁড়া করে দুধের সাথে গ্রহণ।
- নারীদের মাসিক সমস্যা বা গর্ভকালীন পুষ্টিতে ব্যবহার করা হয়।
রোগে ব্যবহার:
| রোগ | ব্যবহার | পরিমাণ |
|---|---|---|
| দুর্বলতা | গুঁড়া + দুধ | দিনে ২ বার |
| স্ত্রীরোগ | গুঁড়া + মধু | দিনে ১ বার |
| হরমোন সমস্যা | গুঁড়া | পরামর্শক্রমে |
সতর্কতা:
- হরমোনজনিত রোগ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
- বেশি মাত্রায় ব্যবহারে ওজন বেড়ে যেতে পারে।
🌳 ১০. মহুয়া (Mahua)

- বৈজ্ঞানিক নাম: Madhuca indica
- পরিবার: Sapotaceae
ঔষধি গুণাগুণ:
- শারীরিক শক্তি বাড়ায়
- বাত ব্যথা উপশম করে
- রক্তস্বল্পতায় উপকারী
- ত্বকের রোগে ব্যবহারযোগ্য
ব্যবহৃত অংশ:
ফুল, বীজ, তেল, ছাল
ব্যবহারের পদ্ধতি:
- মহুয়ার তেল বাত ব্যথার জায়গায় মালিশ করা হয়।
- মহুয়া ফুল শুকিয়ে গুঁড়া করে খাওয়ার অভ্যাস।
- ত্বকের জ্বালাপোড়ায় ফুলের পেস্ট ব্যবহার করা হয়।
রোগে ব্যবহার:
| রোগ | ব্যবহার | পরিমাণ |
|---|---|---|
| বাত ব্যথা | তেল মালিশ | দিনে ১-২ বার |
| রক্তস্বল্পতা | ফুল গুঁড়া | ১ চা চামচ |
| ত্বকের রোগ | পেস্ট | প্রয়োজনে |
সতর্কতা:
- মহুয়া থেকে তৈরি করা মদ জাতীয় পণ্য গ্রহণে পরিহারযোগ্য।
- দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারে চিকিৎসা নির্দেশ প্রয়োজন।
✅ সারাংশ টেবিল: ১০টি বনজ গাছের সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক তালিকা
| গাছের নাম | বৈজ্ঞানিক নাম | মূল ঔষধি গুণ | ব্যবহৃত অংশ | সতর্কতা |
|---|---|---|---|---|
| অর্জুন | Terminalia arjuna | হার্ট টনিক | ছাল | গর্ভবতীদের জন্য নিষেধ |
| বহেড়া | Terminalia bellirica | হজমে সহায়ক | ফল | মাত্রা মেনে ব্যবহার |
| নিম | Azadirachta indica | জীবাণুনাশক | পাতা, তেল | যকৃতের উপর প্রভাব |
| গুলঞ্চ | Tinospora cordifolia | রোগ প্রতিরোধ | লতা | পেট খারাপ হতে পারে |
| হরীতকী | Terminalia chebula | হজম ও স্নায়ু শক্তি | ফল | উচ্চ রক্তচাপে সতর্কতা |
| কালমেঘ | Andrographis paniculata | লিভার টনিক | পাতা | অতিরিক্তে রক্তচাপ কমে |
| তুলসী | Ocimum sanctum | ঠান্ডা-কাশি নিরাময় | পাতা | বেশি খেলেই পেট সমস্যা |
| বাসক | Justicia adhatoda | কাশি ও হাঁপানি | পাতা | গর্ভবতীদের জন্য নয় |
| শতমূলি | Asparagus racemosus | হরমোন ব্যালান্স | মূল | হরমোন রোগীদের সতর্কতা |
| মহুয়া | Madhuca indica | বাত ও শক্তি বর্ধক | ফুল, তেল | মদজাতীয় ব্যবহার নয় |
📌 উপসংহার
বাংলাদেশের বনাঞ্চলে ও গ্রামের বসতবাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এসব বনজ গাছ শুধুমাত্র পরিবেশ রক্ষায় নয়, বরং মানুষের শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এসব গাছের ঔষধি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আপনার আশেপাশে যেসব বনজ গাছ আছে, সেগুলোর গুণাগুণ জানুন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করুন — তবে কখনোই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত গ্রহণ নয়।
