খিরসাপাত আম বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু আম। এটি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলীর জন্য বিখ্যাত। খিরসাপাত আম, যা সাধারণত হিমসাগর নামে পরিচিত, বাংলাদেশের অন্যতম সুস্বাদু এবং জনপ্রিয় আমের জাত। বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর ও মেহেরপুর অঞ্চলে এর ব্যাপক চাষ হয়। খিরসাপাত আম তাদের অনন্য স্বাদ, মিষ্টতা এবং সুগন্ধের জন্য ব্যাপকভাবে সমাদৃত। নিচে খিরসাপাত আমের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলঃ
বৈশিষ্ট্য
আকার: খিরসাপাত আমের আকার সাধারণত মাঝারি থেকে বড় হয়ে থাকে। প্রতিটি আমের ওজন গড়ে ২৫০-৩০০ গ্রাম হয়।রঙ পাকা খিরসাপাত আমের ত্বক হলুদ রঙের হয় এবং এতে লালচে আভা থাকতে পারে।আকৃতি আমের আকৃতি কিছুটা লম্বাটে এবং ডিম্বাকার।ত্বক মসৃণ এবং পাতলা ত্বক।
অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য
খিরসাপাত আমের গুড়ি (কান্ড) ছোট এবং পাতলা। খুবই রসালো, যা খেতে অত্যন্ত মিষ্টি। ফাইবারহীন এবং মসৃণ মাংসল অংশ, খেতে খুব মিষ্টি এবং সুগন্ধযুক্ত। অভ্যন্তরীণ অংশের রঙ সাধারণত উজ্জ্বল হলুদ।ও পুষ্টিগুণ
খিরসাপাত আম বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানে ভরপুর:
ভিটামিন সি: উচ্চমাত্রায় বিদ্যমান, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।ভিটামিন এ: এতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে যা চোখের জন্য ভালো।ফাইবার: আঁশবিহীন হলেও এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা হজমে সহায়ক ম্যাঙ্গানিজ, পটাসিয়াম এই খনিজ উপাদানগুলোও বিদ্যমান।
স্বাদ এবং ব্যবহার
খিরসাপাত আমের স্বাদ খুবই মিষ্টি এবং সুগন্ধিযুক্ত। এতে কোনো তিক্ততা বা খোসার গন্ধ নেই।ব্যবহার খিরসাপাত আম সাধারণত কাঁচা খাওয়া হয়, তবে এটি দিয়ে জুস, স্মুদি, ডেজার্ট, চাটনি এবং অন্যান্য মিষ্টান্ন প্রস্তুত করা যায়।
চাষের সময় এবং এলাকা
চাষের সময়: সাধারণত মে থেকে জুন মাসের মধ্যে খিরসাপাত আম পাকে।চাষের এলাকা খিরসাপাত আম মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, দিনাজপুর, এবং মেহেরপুর অঞ্চলে বেশি চাষ হয়।
বিশেষত্বএর মিষ্টতা ও সুগন্ধির জন্য এটি ‘রসের রাজা’ নামে পরিচিত।বাজার মূল্য অন্যান্য আমের তুলনায় খিরসাপাত আমের বাজার মূল্য বেশি, কারণ এটি উচ্চমানের এবং সুস্বাদু।খিরসাপাত আম তার অনন্য স্বাদ, পুষ্টিগুণ, এবং সহজলভ্যতার জন্য বাংলাদেশের ভোক্তাদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়।
খিরসাপাত আম চাষ
খিরসাপাত আমের চাষ পদ্ধতি বিভিন্ন ধাপের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এই আমটি তার মিষ্টি স্বাদ, সুগন্ধি, এবং কম আঁশের জন্য বিখ্যাত। খিরসাপাত আমের চাষ পদ্ধতি নিম্নে দেওয়া হলো:
১. জলবায়ু এবং মাটি
জলবায়ু: খিরসাপাত আম গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। পর্যাপ্ত সূর্যালোক ও গ্রীষ্মের তাপমাত্রা প্রয়োজন।
মাটি: দো-আঁশ এবং বেলে-দোআঁশ মাটি খিরসাপাত আম চাষের জন্য উপযুক্ত। মাটির পিএইচ ৬-৭ এর মধ্যে থাকা ভালো।
২. বীজ এবং চারার প্রস্তুতি
চারা: খিরসাপাত আমের জন্য সাধারণত কলম বা গ্রাফটিং চারা ব্যবহার করা হয়। ভালো মানের, রোগমুক্ত এবং সুস্থ চারা নির্বাচন করা উচিত।
৩. জমি প্রস্তুতি
গর্ত খনন: চারা রোপণের জন্য ১ মিটার x ১ মিটার x ১ মিটার আকারের গর্ত খনন করতে হবে।এবং গর্ত পূরণ গর্তগুলো ভালভাবে পচা গোবর, ভার্মিকম্পোস্ট এবং উপযুক্ত পরিমাণে টপ সয়েল মিশিয়ে পূরণ করতে হবে।
৪. চারা রোপণ
রোপণের সময়: বর্ষার আগে বা পরে অর্থাৎ মে-জুলাই মাস খিরসাপাত আমের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
রোপণ পদ্ধতি: চারা রোপণের সময় মাটি থেকে কলমের অংশ ১৫ সেমি উঁচু রাখা উচিত। চারার গোড়ার মাটি আলগা করে মাটি দিয়ে চেপে ধরে পানি দিতে হবে।
৫. সেচ এবং নিষিক্তকরণ
সেচ: প্রথমে নিয়মিত সেচ দিতে হবে, বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে। পরবর্তী বছরগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে প্রতি ১৫ দিনে একবার সেচ দেওয়া যেতে পারে।
নিষিক্তকরণ: গোবর সার, ভার্মিকম্পোস্ট, এবং রাসায়নিক সার (যেমন: নাইট্রোজেন, ফসফরাস, এবং পটাশ) প্রয়োগ করতে হবে।
৬. সার প্রয়োগর পদ্ধতি
খিরসাপাত আমের চাষে সঠিক সার প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে ফলের মান উন্নত হয় এবং উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। নিচে খিরসাপাত আম চাষের বিভিন্ন পর্যায়ে সার প্রয়োগের পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো:
চারা রোপণের আগেঃ
গর্ত প্রস্তুতকরণ চারা রোপণের জন্য ২.৫ ফুট x ২.৫ ফুট x ২.৫ ফুট আকারের গর্ত করতে হবে। গর্তে ১৫-২০ কেজি পচা গোবর বা কম্পোস্ট সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) এবং ২৫০ গ্রাম এমওপি (মিউরিয়েট অব পটাশ) মিশিয়ে দিতে হবে। সারগুলো ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে ১৫-২০ দিন গর্ত খোলা রেখে দিতে হবে।
চারা রোপণের পর (প্রথম বছর)
ইউরিয়া ৫০-১০০ গ্রাম (গাছের চারপাশে ছিটিয়ে দিয়ে সেচ দিতে হবে)। টিএসপি ৫০-১০০ গ্রাম (মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে)।
এমওপি ৫০-১০০ গ্রাম (মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে)।
দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম বছর পর্যন্তঃ
ইউরিয়া ১৫০-২৫০ গ্রাম। টিএসপি ১০০-২০০ গ্রাম। এমওপি ১৫০-২৫০ গ্রাম।
পূর্ণবয়স্ক গাছ (পাঁচ বছরের বেশি বয়সী)
ইউরিয়া ৫০০-৭০০ গ্রাম। টিএসপি ৩০০-৫০০ গ্রাম। এমওপি ৩০০-৫০০ গ্রাম।:২০-২৫ কেজি (বছরে একবার)।
সার প্রয়োগের সময়ঃ
প্রথম বার ফুল আসার আগে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ)।দ্বিতীয় বার ফল ধরার সময় (মে-জুন)।তৃতীয় বার ফল সংগ্রহের পরে (জুলাই-আগস্ট)।
সার প্রয়োগের পদ্ধতিঃ
গাছের ড্রিপ লাইনের চারপাশে ৮-১০ ইঞ্চি গভীর গর্ত তৈরি করতে হবে।নির্দিষ্ট পরিমাণে সার মাটির সাথে মিশিয়ে গর্তে প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগের পরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি দিতে হবে যাতে সার ভালোভাবে মাটির সাথে মিশে যায়।
অতিরিক্ত যত্নঃ
খরার সময়ে গাছকে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করতে হবে। গাছের চারপাশে আগাছা যেন না বাড়ে, সেজন্য নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।পোকামাকড় এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য সময়মতো প্রয়োজনীয় কীটনাশক এবং ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে।
এই পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করলে খিরসাপাত আমের ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব এবং গাছ সুস্থ থাকবে।
৭. রোগ এবং পোকা-মাকড় ব্যবস্থাপনা
রোগ: খিরসাপাত আমের সাধারণ রোগগুলোর মধ্যে আছে অ্যানথ্রাকনোজ, পাউডারি মিলডিউ। প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত ফাঙ্গিসাইড স্প্রে করা যেতে পারে।
পোকা-মাকড়: আমের ফলমাছি, লিফহপার ইত্যাদি পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য নিয়মিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
৮. ফল সংগ্রহেরঃ সময় মে থেকে জুন মাসে খিরসাপাত আম সংগ্রহ করা হয়।
পাকা আমের চিহ্ন: আম পাকলে ত্বকের রঙ কিছুটা পরিবর্তিত হয় এবং ফলটি নরম হয়।
উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো মেনে চললে খিরসাপাত আমের ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। নিয়মিত যত্ন ও পর্যবেক্ষণ আমের গুণগত মান ও পরিমাণ উভয়ই বাড়াতে সাহায্য করবে।