১০টি লাভজনক মসলা চাষ: সম্পূর্ণ গাইড
ভূমিকা
বাংলাদেশের কৃষিতে মসলার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এলাচ, দারুচিনি, গোলমরিচ, লবঙ্গ, জয়ফল, হলুদ, ধনিয়া, মৌরি, মেথি এবং আরও অনেক মসলা শুধু রান্নার স্বাদ ও ঘ্রাণ বাড়ায় না, বরং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। মসলা ফসলের চাহিদা সারা বছর থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদে এগুলো চাষে লাভও অনেক বেশি।
মসলা চাষের অন্যতম সুবিধা হলো — এগুলো তুলনামূলক কম জায়গায়, সীমিত শ্রম ও কম সেচে চাষ করা যায়। এছাড়া, সঠিক বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণ করলে মসলা ফসল থেকে সারা বছর আয় করা সম্ভব।
দ্রষ্টব্য: মসলা চাষে সঠিক জাত নির্বাচন, মাটি প্রস্তুতি ও রোগবালাই দমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
লাভজনক মসলা নং ১ — এলাচ চাষ

এলাচকে “মসলার রানি” বলা হয়। এটি মূলত পাহাড়ি ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ভালো জন্মে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এলাকায় এলাচ চাষে ভালো সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এলাচের চাহিদা ও দাম দুইই বেশি হওয়ায় এটি অত্যন্ত লাভজনক।
মাটি ও আবহাওয়া
- উপযুক্ত তাপমাত্রা: ১০°–৩৫°C
- বার্ষিক বৃষ্টিপাত: ১৫০০–৪০০০ মিমি
- ছায়াযুক্ত ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দোআঁশ মাটি
রোপণের সময় ও জমি প্রস্তুতি
বর্ষা শুরুর আগে (মে–জুন) এলাচ চারা রোপণ করা উত্তম। জমিতে আগাছা পরিষ্কার করে ৬০ সেমি × ৬০ সেমি গর্ত তৈরি করতে হবে এবং প্রতি গর্তে ১০–১২ কেজি পচা গোবর মিশিয়ে চারা লাগাতে হবে।
সার প্রয়োগ পরিকল্পনা
| সারের নাম | পরিমাণ (প্রতি গাছ) | প্রয়োগের সময় |
|---|---|---|
| পচা গোবর | ১০–১২ কেজি | রোপণের সময় |
| ইউরিয়া | ৫০ গ্রাম | প্রতি ৪ মাস অন্তর |
| টিএসপি | ৩০ গ্রাম | প্রতি ৪ মাস অন্তর |
| এমওপি | ২০ গ্রাম | প্রতি ৪ মাস অন্তর |
রোগবালাই ও প্রতিকার
- পাতা পচা রোগ: বোর্দো মিশ্রণ ১% স্প্রে
- গাছের গোড়া পচা: মাটিতে ট্রাইকোডার্মা মেশানো
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
রোপণের ২–৩ বছর পর থেকে ফল ধরা শুরু হয়। একবার রোপণ করলে ৭–৮ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ৩০০–৪০০ কেজি শুকনা এলাচ পাওয়া যায়।
বাজারদর ও লাভ
বাংলাদেশে শুকনা এলাচের বাজারদর প্রতি কেজি ৩,০০০–৩,৫০০ টাকা। সঠিক যত্ন নিলে প্রতি হেক্টরে ১০–১২ লাখ টাকা আয় সম্ভব।
লাভজনক মসলা নং ২ — গোলমরিচ চাষ

গোলমরিচ বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় মসলা, যা “মসলার রাজা” নামে পরিচিত। এটি রান্নার স্বাদ ও ঘ্রাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি ঔষধি গুণেও সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও পার্বত্য অঞ্চলে এর বাণিজ্যিক চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
মাটি ও আবহাওয়া
- তাপমাত্রা: ১৫°–৩৫°C
- বৃষ্টিপাত: বছরে ২০০০–৩০০০ মিমি
- জৈব পদার্থসমৃদ্ধ দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি
- ছায়াযুক্ত পরিবেশ
রোপণের সময় ও জমি প্রস্তুতি
বর্ষা শুরুর আগে (মে–জুন) গোলমরিচের কলম বা চারা রোপণ করতে হয়। প্রতিটি গাছের জন্য ৫০–৬০ সেমি গর্ত করে ১০–১৫ কেজি পচা গোবর মেশানো উচিত। গাছকে উপরে উঠতে সহায়তা করার জন্য কাঠ বা জীবন্ত গাছকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সার প্রয়োগ পরিকল্পনা
| সারের নাম | পরিমাণ (প্রতি গাছ) | প্রয়োগের সময় |
|---|---|---|
| পচা গোবর | ১০–১৫ কেজি | রোপণের সময় |
| ইউরিয়া | ৫০ গ্রাম | প্রতি ৪ মাস অন্তর |
| টিএসপি | ৫০ গ্রাম | প্রতি ৪ মাস অন্তর |
| এমওপি | ৩০ গ্রাম | প্রতি ৪ মাস অন্তর |
সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ
শুকনো মৌসুমে ১৫–২০ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। বছরে অন্তত ৩–৪ বার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করলে আর্দ্রতা ধরে রাখা সহজ হয় এবং আগাছা কম জন্মে।
রোগবালাই ও প্রতিকার
- পাতা পচা রোগ: ১% বোর্দো মিশ্রণ স্প্রে
- মূল পচা রোগ: মাটিতে ট্রাইকোডার্মা প্রয়োগ
- পাতা কুঁকড়ে যাওয়া: নিম তেল স্প্রে (জৈব পদ্ধতি)
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
রোপণের ২–৩ বছর পর ফল ধরা শুরু হয়। সবুজ ফল সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে কালো গোলমরিচ তৈরি করা হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ১.৫–২ টন শুকনো গোলমরিচ উৎপাদন সম্ভব।
বাজারদর ও লাভ
বাংলাদেশে শুকনো গোলমরিচের বাজারদর প্রতি কেজি ৫০০–৭০০ টাকা। এক হেক্টরে ১০–১২ লাখ টাকার গোলমরিচ উৎপাদন করা যায়, যেখানে উৎপাদন খরচ গড়ে ৩–৪ লাখ টাকা।
বিশেষ টিপস: গোলমরিচ গাছে বেশি ফলন পেতে জীবন্ত খুঁটি (যেমন সাপলুডি বা কাজুবাদাম গাছ) ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
লাভজনক মসলা নং ৩ — দারুচিনি চাষ

দারুচিনি হলো একটি সুগন্ধি মসলা যা গাছের ছাল থেকে সংগ্রহ করা হয়। এটি রান্না, মিষ্টি প্রস্তুত, ওষুধ এবং সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, সিলেট, বান্দরবান এবং রাঙ্গামাটি অঞ্চলে দারুচিনি চাষের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে।
মাটি ও আবহাওয়া
- তাপমাত্রা: ২০°–৩০°C
- বৃষ্টিপাত: বছরে ২০০০–২৫০০ মিমি
- উঁচু ভূমি ও পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি
- pH: ৫.০–৬.৫
রোপণের সময় ও জমি প্রস্তুতি
বর্ষা মৌসুমে (জুন–আগস্ট) দারুচিনির চারা রোপণ করা সবচেয়ে ভালো। ৫০×৫০×৫০ সেমি আকারের গর্ত তৈরি করে তাতে ৮–১০ কেজি পচা গোবর, ৫০ গ্রাম টিএসপি ও ২৫ গ্রাম এমওপি মিশিয়ে চারা রোপণ করতে হবে। গাছের মধ্যে দূরত্ব রাখতে হবে ২.৫–৩ মিটার।
সার প্রয়োগ পরিকল্পনা
| সারের নাম | পরিমাণ (প্রতি গাছ) | প্রয়োগের সময় |
|---|---|---|
| পচা গোবর | ৮–১০ কেজি | রোপণের সময় |
| ইউরিয়া | ১০০ গ্রাম | প্রতি বছর বর্ষার শুরুতে |
| টিএসপি | ৫০ গ্রাম | প্রতি বছর বর্ষার শুরুতে |
| এমওপি | ২৫ গ্রাম | প্রতি বছর বর্ষার শুরুতে |
সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ
দারুচিনি গাছ সাধারণত অতিরিক্ত সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে খরা মৌসুমে মাসে ১–২ বার সেচ দিতে হবে। বছরে ৩–৪ বার আগাছা পরিষ্কার করা দরকার।
রোগবালাই ও প্রতিকার
- পাতা দাগ রোগ: ১% বোর্দো মিশ্রণ স্প্রে
- কাণ্ড পচা: আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলে ট্রাইকোডার্মা প্রয়োগ
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
দারুচিনি গাছ রোপণের ৩–৪ বছর পর থেকে ছাল সংগ্রহ শুরু করা যায়। ছাল সংগ্রহের পর রোদে শুকিয়ে বাজারজাত করা হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ২৫০–৩০০ কেজি শুকনা দারুচিনি পাওয়া যায়।
বাজারদর ও লাভ
বাংলাদেশে শুকনা দারুচিনির বাজারদর প্রতি কেজি ৮০০–১২০০ টাকা। এক হেক্টরে বার্ষিক গড়ে ৬–৮ লাখ টাকা আয় সম্ভব, যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ২–৩ লাখ টাকা।
বিশেষ টিপস: দারুচিনি গাছ ছাঁটাই করলে নতুন ডাল দ্রুত গজায় এবং ছালের মান উন্নত হয়।
লাভজনক মসলা নং ৪ — লবঙ্গ চাষ

লবঙ্গ একটি সুগন্ধি ও মূল্যবান মসলা, যা রান্নার স্বাদ বৃদ্ধির পাশাপাশি ঔষধি গুণের জন্যও বিখ্যাত। এটি মূলত গাছের শুকনো ফুলের কুঁড়ি থেকে পাওয়া যায়। লবঙ্গের তেলও বাজারে অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন, যা পারফিউম, টুথপেস্ট ও ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলে লবঙ্গ চাষের সম্ভাবনা রয়েছে।
মাটি ও আবহাওয়া
- তাপমাত্রা: ২০°–৩০°C
- বৃষ্টিপাত: ১৫০০–২৫০০ মিমি
- উর্বর, পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত দোআঁশ মাটি
- pH: ৫.৫–৬.৫
রোপণের সময় ও জমি প্রস্তুতি
বর্ষা শুরুর আগে (মে–জুন) লবঙ্গের কলম বা চারা রোপণ করা সবচেয়ে ভালো। গাছের মধ্যে ৬–৭ মিটার দূরত্ব রাখতে হবে। গর্তের আকার হবে ৬০×৬০×৬০ সেমি এবং তাতে ১৫–২০ কেজি পচা গোবর, ১০০ গ্রাম টিএসপি ও ৫০ গ্রাম এমওপি মিশিয়ে রোপণ করতে হবে।
সার প্রয়োগ পরিকল্পনা
| সারের নাম | পরিমাণ (প্রতি গাছ) | প্রয়োগের সময় |
|---|---|---|
| পচা গোবর | ১৫–২০ কেজি | রোপণের সময় |
| ইউরিয়া | ২০০ গ্রাম | প্রতি বছর বর্ষার আগে |
| টিএসপি | ১০০ গ্রাম | প্রতি বছর বর্ষার আগে |
| এমওপি | ৫০ গ্রাম | প্রতি বছর বর্ষার আগে |
সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ
লবঙ্গ গাছে অতিরিক্ত সেচের প্রয়োজন নেই, তবে শুষ্ক মৌসুমে ১৫–২০ দিন অন্তর হালকা সেচ দিতে হবে। বছরে ৩–৪ বার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। মালচিং ব্যবহার করলে আর্দ্রতা বজায় থাকে।
রোগবালাই ও প্রতিকার
- পাতা দাগ রোগ: ১% বোর্দো মিশ্রণ স্প্রে
- মূল পচা: মাটিতে ট্রাইকোডার্মা প্রয়োগ
- পোকা আক্রমণ: নিম তেল স্প্রে (জৈব নিয়ন্ত্রণ)
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
লবঙ্গ গাছ রোপণের ৫–৬ বছর পর ফুলের কুঁড়ি আসা শুরু হয়। অপরিপক্ব কুঁড়ি সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে লবঙ্গ প্রস্তুত করা হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ২৫০–৩০০ কেজি শুকনো লবঙ্গ পাওয়া যায়।
বাজারদর ও লাভ
বাংলাদেশে শুকনা লবঙ্গের বাজারদর প্রতি কেজি ১,২০০–১,৬০০ টাকা। এক হেক্টরে ৫–৭ লাখ টাকার লবঙ্গ উৎপাদন সম্ভব, যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ২–৩ লাখ টাকা।
বিশেষ টিপস: লবঙ্গ চাষে গাছকে ঝড় থেকে রক্ষা করার জন্য প্রাকৃতিক বাতাবরণ (উচ্চ গাছের ছায়া) রাখা ভালো।
লাভজনক মসলা নং ৫ — জয়ফল ও জয়ত্রী চাষ

জয়ফল (Nutmeg) ও জয়ত্রী (Mace) একই গাছের দুটি মূল্যবান মসলা। জয়ফল হলো ফলের বীজ, আর জয়ত্রী হলো বীজের বাইরের লাল আচ্ছাদন। এ দুটি মসলা রান্না, মিষ্টি, বেকারি পণ্য, ঔষধ এবং প্রসাধনীতে ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা অত্যন্ত বেশি।
মাটি ও আবহাওয়া
- তাপমাত্রা: ২৫°–৩৫°C
- বৃষ্টিপাত: ২০০০–৩০০০ মিমি
- দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি, পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত
- pH: ৫.৫–৬.৫
রোপণের সময় ও জমি প্রস্তুতি
বর্ষা শুরুর আগে (মে–জুন) জয়ফল ও জয়ত্রী চারা রোপণ করা হয়। গাছের মধ্যে ৮–১০ মিটার দূরত্ব রাখতে হবে। গর্তের আকার হবে ৬০×৬০×৬০ সেমি এবং তাতে ২০–২৫ কেজি পচা গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি মিশিয়ে রোপণ করতে হবে।
সার প্রয়োগ পরিকল্পনা
| সারের নাম | পরিমাণ (প্রতি গাছ) | প্রয়োগের সময় |
|---|---|---|
| পচা গোবর | ২০–২৫ কেজি | রোপণের সময় |
| ইউরিয়া | ২৫০ গ্রাম | প্রতি বছর বর্ষার আগে |
| টিএসপি | ২০০ গ্রাম | প্রতি বছর বর্ষার আগে |
| এমওপি | ১০০ গ্রাম | প্রতি বছর বর্ষার আগে |
সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ
বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত সেচের প্রয়োজন হয় না। শুষ্ক মৌসুমে ১৫–২০ দিন অন্তর হালকা সেচ দিতে হবে। বছরে ৩–৪ বার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। মালচিং দিলে মাটির আর্দ্রতা বজায় থাকে।
রোগবালাই ও প্রতিকার
- পাতা দাগ রোগ: ১% বোর্দো মিশ্রণ স্প্রে
- মূল পচা: মাটিতে ট্রাইকোডার্মা প্রয়োগ
- পোকা আক্রমণ: নিম তেল স্প্রে
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
গাছ রোপণের ৭–৮ বছর পর থেকে ফল আসা শুরু হয়। ফল পাকার পর বীজ সংগ্রহ করে জয়ফল হিসেবে ব্যবহার করা হয়, আর বীজের বাইরের লাল আচ্ছাদন শুকিয়ে জয়ত্রী হিসেবে বাজারজাত করা হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ৮০০–১০০০ কেজি জয়ফল এবং ১০০–১৫০ কেজি জয়ত্রী পাওয়া যায়।
বাজারদর ও লাভ
বাংলাদেশে জয়ফলের বাজারদর প্রতি কেজি ৬০০–৮০০ টাকা এবং জয়ত্রীর বাজারদর ২০০০–২৫০০ টাকা। এক হেক্টরে গড়ে ১০–১২ লাখ টাকার উৎপাদন সম্ভব, যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ৩–৪ লাখ টাকা।
বিশেষ টিপস: জয়ফল ও জয়ত্রী গাছের জন্য হালকা ছায়া উপকারী, তাই নারকেল বা সুপারি গাছের সঙ্গে মিশ্র চাষ করা ভালো।
লাভজনক মসলা নং ৬ — আদা (Ginger) চাষ

ভূমিকা
আদা একটি বহুল ব্যবহৃত মসলা যা রান্না, ওষুধ, চা, আচার ও প্রসাধনীতে ব্যবহার হয়। বিশ্বব্যাপী আদার চাহিদা অনেক বেশি, তাই এটি ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে আদা চাষ করা যায়।
মাটি ও আবহাওয়া
- তাপমাত্রা: ২০°–৩০°C
- বৃষ্টিপাত: ১৫০০–২৫০০ মিমি
- উর্বর, দোআঁশ বা বেলে দোআশ মাটি
- pH: ৫.৫–৬.৫
রোপণের সময় ও জমি প্রস্তুতি
আদা সাধারণত ফেব্রুয়ারি–মার্চ মাসে রোপণ করা হয়। জমি ভালোভাবে চাষ করে, ৩০×৩০ সেমি দূরত্বে ৫–৭ সেমি গভীরে রাইজোম বসানো হয়। মাটি নরম এবং পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত হওয়া উচিত।
সার প্রয়োগ পরিকল্পনা
| সারের নাম | পরিমাণ (প্রতি ১০০ বর্গমিটার) | প্রয়োগের সময় |
|---|---|---|
| পচা গোবর | ১৫–২০ কেজি | রোপণের সময় মিশ্রিত |
| ইউরিয়া | ২০০ গ্রাম | প্রতি ২ মাসে একবার |
| টিএসপি | ১৫০ গ্রাম | রোপণের সময় মিশ্রিত |
| এমওপি | ১০০ গ্রাম | রোপণের সময় মিশ্রিত |
সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ
বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত সেচের প্রয়োজন হয় না। শুষ্ক মৌসুমে ১৫–২০ দিন অন্তর হালকা সেচ দিতে হবে। আগাছা বছরে ২–৩ বার পরিষ্কার করা উচিত।
রোগবালাই ও প্রতিকার
- মূল পচা: মাটিতে ট্রাইকোডার্মা প্রয়োগ
- পাতা দাগ: হালকা ফাঙ্গিসাইড স্প্রে
- পোকা আক্রমণ: জৈব কীটনাশক বা নিম তেল স্প্রে
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
আদা রোপণের ৮–১০ মাস পরে কেটে তোলা হয়। রাইজোম মাটি থেকে বের করে রোদে শুকিয়ে বাজারজাত করা হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ১৫–২০ টন আদা পাওয়া যায়।
বাজারদর ও লাভ
বাংলাদেশে আদার বাজারদর প্রতি কেজি ৬০–৮০ টাকা। প্রতি হেক্টরে ১০–১৫ লাখ টাকার উৎপাদন সম্ভব, যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ৩–৪ লাখ টাকা।
বিশেষ টিপস: আদা চাষে নিয়মিত সেচ, পর্যাপ্ত আলো এবং মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। শুষ্ক মৌসুমে হালকা সেচ দিলে ফসল ভালো হয়।
লাভজনক মসলা নং ৭ — তারকামরিচ (Star Anise) চাষ

তারকামরিচ একটি সুগন্ধি মসলা যা দেখতে তারকার মতো এবং এর স্বাদ হালকা মিষ্টি ও ঝাঁঝালো। এটি মূলত চীনা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ওষুধ, পারফিউম, এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে এর চাহিদা অনেক বেশি। বাংলাদেশে পাহাড়ি ও উঁচু জমিতে এর চাষ সম্ভাবনাময়।
মাটি ও আবহাওয়া
- তাপমাত্রা: ২০°–৩০°C
- বৃষ্টিপাত: ১৫০০–২৫০০ মিমি
- জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দোআঁশ বা পাহাড়ি লাল মাটি
- pH: ৫.৫–৬.৫
রোপণের সময় ও জমি প্রস্তুতি
বর্ষা শুরুর আগে (এপ্রিল–মে) চারা রোপণের জন্য জমি প্রস্তুত করতে হয়। গাছের মধ্যে ৩×৩ মিটার দূরত্ব রাখা হয়। প্রতিটি গর্ত ৪৫×৪৫×৪৫ সেমি করে খুঁড়ে ১৫–২০ কেজি পচা গোবর, ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৫০ গ্রাম এমওপি মিশিয়ে চারা রোপণ করতে হয়।
সার প্রয়োগ পরিকল্পনা
| সারের নাম | পরিমাণ (প্রতি গাছ) | প্রয়োগের সময় |
|---|---|---|
| পচা গোবর | ১৫–২০ কেজি | রোপণের সময় |
| ইউরিয়া | ১৫০ গ্রাম | প্রতি বছর বর্ষার আগে |
| টিএসপি | ১০০ গ্রাম | প্রতি বছর বর্ষার আগে |
| এমওপি | ৫০ গ্রাম | প্রতি বছর বর্ষার আগে |
সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ
তারকামরিচ গাছ বর্ষায় প্রাকৃতিক বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল, তবে শুষ্ক মৌসুমে মাসে একবার সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। বছরে ২–৩ বার আগাছা পরিষ্কার করা জরুরি।
রোগবালাই ও প্রতিকার
- পাতা কুঁচকে যাওয়া: নিম তেল বা জৈব কীটনাশক স্প্রে
- মূল পচা রোগ: মাটিতে ট্রাইকোডার্মা প্রয়োগ
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
রোপণের ৫–৬ বছর পর থেকে ফলন শুরু হয়। ফল সবুজ থেকে বাদামি হলে সংগ্রহ করা হয়। শুকিয়ে বাজারজাত করা হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ১০০০–১৫০০ কেজি শুকনো তারকামরিচ পাওয়া যায়।
বাজারদর ও লাভ
বাংলাদেশে তারকামরিচের দাম প্রতি কেজি ৮০০–১২০০ টাকা। প্রতি হেক্টরে গড়ে ৮–১২ লাখ টাকার উৎপাদন সম্ভব, যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ৩–৪ লাখ টাকা।
বিশেষ টিপস: তারকামরিচ চাষে অর্ধছায়াযুক্ত স্থান ও পাহাড়ি উঁচু জমি সবচেয়ে উপযোগী।
লাভজনক মসলা নং ৮ — জাফরান (Saffron) চাষ

জাফরান বিশ্বের সবচেয়ে দামি মসলা হিসেবে পরিচিত। এটি মূলত কুঁকড়ি থেকে সংগ্রহ করা হয়। রান্না, মিষ্টি, ওষুধ, প্রসাধনী ও সুগন্ধি শিল্পে জাফরানের চাহিদা অত্যন্ত বেশি। সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে খুব কম জমিতেও ভালো লাভ পাওয়া যায়।
মাটি ও আবহাওয়া
- তাপমাত্রা: ১৫°–২০°C
- বৃষ্টিপাত: ৩০০–৫০০ মিমি (শুষ্ক আবহাওয়া ভালো)
- হালকা, উঁচু, বেলে দোআঁশ বা ড্রেনেজ ভাল মাটি
- pH: ৬.০–৭.০
রোপণের সময় ও জমি প্রস্তুতি
জাফরানের কন্দ (Corm) অক্টোবর–নভেম্বর মাসে রোপণ করা হয়। গর্ত ১০×১০ সেমি করে ৫–৭ সেমি গভীরে কন্দ বসানো হয়। সারপ্রয়োগ ও মাটি ভরাট করার পর চারা জলীয় রাখার প্রয়োজন নেই।
সার প্রয়োগ পরিকল্পনা
| সারের নাম | পরিমাণ (প্রতি ১০০ কন্দ) | প্রয়োগের সময় |
|---|---|---|
| পচা গোবর | ১–২ কেজি | রোপণের সময় মিশ্রিত |
| টিএসপি | ১০–২০ গ্রাম | রোপণের সময় মিশ্রিত |
| এমওপি | ৫–১০ গ্রাম | রোপণের সময় মিশ্রিত |
সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ
জাফরানকে অতিরিক্ত সেচের প্রয়োজন হয় না। শুষ্ক মৌসুমে হালকা সেচ দিলে ভালো। আগাছা প্রতিবার সামান্য হাত দিয়ে বা হালকা কাণ্ড কেটে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
রোগবালাই ও প্রতিকার
- কন্দ পচা: ট্রাইকোডার্মা বা বায়োফাঙ্গাস প্রয়োগ
- পাতা দাগ: হালকা ফাঙ্গিসাইড স্প্রে
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
রোপণের ৬–৮ সপ্তাহ পরে কুঁকড়ি ফোটে। প্রতিদিন সকালে কুঁকড়ি সংগ্রহ করতে হয়। পরে সূক্ষ্ম ডেডলক পদ্ধতিতে শুকিয়ে জাফরান তৈরি করা হয়। প্রতি ১০০ কন্দ থেকে মাত্র ৫–৭ গ্রাম শুকনো জাফরান পাওয়া যায়।
বাজারদর ও লাভ
বাংলাদেশে জাফরানের বাজারদর প্রতি গ্রাম ৩০–৫০ টাকা, আন্তর্জাতিক বাজারে এটি অনেক বেশি। ছোট জমিতেও লাভজনক উৎপাদন সম্ভব, যেখানে ১০০ কন্দ থেকে প্রায় ৫–৭ হাজার টাকা আয় করা যায়।
বিশেষ টিপস: জাফরান চাষে রোদ সরাসরি না লাগার স্থান ভালো। হালকা ছায়াযুক্ত উঁচু জমি সবচেয়ে উপযোগী।
লাভজনক মসলা নং ৯ — মৌরি (Fenugreek) চাষ

ভূমিকা
মৌরি বা Fenugreek হলো একটি সুগন্ধি এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন মসলা। এটি রান্না, আচার, ওষুধ এবং হেলথ সাপ্লিমেন্টে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে মৌরি চাষ করা সহজ এবং ছোট জমিতেও লাভজনক।
মাটি ও আবহাওয়া
- তাপমাত্রা: ২০°–৩৫°C
- বৃষ্টিপাত: ৮০০–১২০০ মিমি
- দোআঁশ বা দোআঁশ-দাঁড়ি মাটি
- pH: ৬.০–৭.০
বীজ বপন সময় ও জমি প্রস্তুতি
মৌরি সাধারণত নভেম্বর–ডিসেম্বর মাসে বপন করা হয়। জমি ভালোভাবে চাষ করে ২০×২০ সেমি দূরত্বে বীজ ছিটিয়ে দিন। মাটি নরম এবং পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত হওয়া উচিত।
সার প্রয়োগ পরিকল্পনা
| সারের নাম | পরিমাণ (প্রতি শত বর্গমিটার) | প্রয়োগের সময় |
|---|---|---|
| পচা গোবর | ৫–১০ কেজি | বীজ বপনের সময় মিশ্রিত |
| টিএসপি | ৫০ গ্রাম | বীজ বপনের সময় মিশ্রিত |
| ইউরিয়া | ২৫–৫০ গ্রাম | বীজ বপনের ৪–৫ সপ্তাহ পরে |
সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ
মৌরি গাছ বর্ষায় প্রাকৃতিক বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে, শুষ্ক মৌসুমে ১০–১৫ দিন অন্তর হালকা সেচ দেওয়া ভালো। আগাছা বছরে ২ বার পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
রোগবালাই ও প্রতিকার
- পাতা দাগ: হালকা ফাঙ্গিসাইড স্প্রে
- মূল পচা: ট্রাইকোডার্মা প্রয়োগ
- পোকা আক্রমণ: জৈব কীটনাশক বা নিম তেল স্প্রে
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
মৌরি বপনের ৩–৪ মাস পরে ফসল তোলা হয়। গাছ কেটে শুকিয়ে বীজ সংগ্রহ করা হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ৮–১২ কেজি শুকনো মৌরি পাওয়া যায়।
বাজারদর ও লাভ
বাংলাদেশে মৌরির বাজারদর প্রতি কেজি ৩৫০–৫০০ টাকা। প্রতি হেক্টরে ৩–৬ লাখ টাকার উৎপাদন সম্ভব, যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ১–২ লাখ টাকা।
বিশেষ টিপস: মৌরি চাষে পর্যাপ্ত আলো, মাটির নরম অবস্থার সঙ্গে সঠিক সেচ গুরুত্বপূর্ণ। শুকিয়ে ফসল সংরক্ষণে পরিষ্কার ও শুকনো জায়গা ব্যবহার করা উচিত।
লাভজনক মসলা নং ১০ — হলুদ (Turmeric) চাষ

হলুদ হলো বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান মসলা। এটি রান্না, ওষুধ, ঔষধি পেস্ট, রঙ, এবং প্রসাধনী শিল্পে ব্যবহৃত হয়। দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজারে হলুদের চাহিদা খুব বেশি। সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে খুব কম সময়ে ভালো আয় সম্ভব।
মাটি ও আবহাওয়া
- তাপমাত্রা: ২০°–৩০°C
- বৃষ্টিপাত: ১৫০০–২৫০০ মিমি
- উর্বর, দোআঁশ বা বেলে দোআশ মাটি
- pH: ৫.৫–৬.৫
রোপণের সময় ও জমি প্রস্তুতি
হলুদের রাইজোম (গুটি) এপ্রিল–মে মাসে রোপণ করা হয়। জমি ভালোভাবে চাষ করে, ২০×২০ সেমি দূরত্বে ৫–৭ সেমি গভীরে রাইজোম বসানো হয়। সেচের জন্য হালকা খাদের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সার প্রয়োগ পরিকল্পনা
| সারের নাম | পরিমাণ (প্রতি ১০০ বর্গমিটার) | প্রয়োগের সময় |
|---|---|---|
| পচা গোবর | ২০–২৫ কেজি | রোপণের সময় মিশ্রিত |
| ইউরিয়া | ২৫০ গ্রাম | প্রতি ২ মাসে একবার |
| টিএসপি | ২০০ গ্রাম | রোপণের সময় মিশ্রিত |
| এমওপি | ১০০ গ্রাম | রোপণের সময় মিশ্রিত |
সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ
বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত সেচের প্রয়োজন হয় না। শুষ্ক মৌসুমে ১৫–২০ দিন অন্তর হালকা সেচ দিলে ভালো। আগাছা বছরে ২–৩ বার পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
রোগবালাই ও প্রতিকার
- মূল পচা: মাটিতে ট্রাইকোডার্মা প্রয়োগ
- পাতা দাগ: হালকা ফাঙ্গিসাইড স্প্রে
- কুঁড়া রোগ: জৈব কীটনাশক প্রয়োগ
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
হলুদ রোপণের ৮–১০ মাস পরে ফসল তোলা হয়। রাইজোম কেটে মাটি থেকে বের করা হয়, রোদে শুকিয়ে বাজারজাত করা হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ১৫–২০ টন হলুদ পাওয়া যায়।
বাজারদর ও লাভ
বাংলাদেশে হলুদের বাজারদর প্রতি কেজি ৫০–৮০ টাকা। প্রতি হেক্টরে ৭–১৫ লাখ টাকার উৎপাদন সম্ভব, যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ৩–৪ লাখ টাকা।
বিশেষ টিপস: হলুদ চাষে নিয়মিত সেচ, পর্যাপ্ত আলো ও মাটির আর্দ্রতা গুরুত্বপূর্ণ। রাইজোম সংরক্ষণের জন্য শুকনো ও পরিষ্কার জায়গা ব্যবহার করা উচিত।
