গম চাষ পদ্ধতি

ভূমিকা

গম একটি গুরুত্বপূর্ণ শস্য যা বিশ্বব্যাপী প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের কৃষি প্রেক্ষাপটে, গম একটি অন্যতম শস্য যা খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গম চাষের জন্য উপযুক্ত জলবায়ু, মাটি, সেচ ব্যবস্থা, এবং সঠিক পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। এই নিবন্ধে, আমরা গম চাষের বিস্তারিত পদ্ধতি, প্রস্তুতি, সেচ ব্যবস্থাপনা, রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণ, এবং ফলন বৃদ্ধি কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।

গম চাষের গুরুত্ব

গম, যা হিসেবে পরিচিত, খাদ্যশস্য হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। এটি প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন B, এবং খনিজ সমৃদ্ধ। বাংলাদেশে গম চাষ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক এবং কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক চাষের সুযোগ প্রদান করে।

মাটি ও জলবায়ু

গম চাষের জন্য ভাল নিষ্কাশনযোগ্য বেলে দোঁআশ বা দোঁআশ মাটি উত্তম। মাটির pH ৫.৫ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে হওয়া উচিত। ভারী মাটি বা জলাবদ্ধ মাটিতে গম চাষ কম ফলন দেয় এবং রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

জলবায়ু:

গম শীতকালীন শস্য হিসেবে পরিচিত এবং এটি শীতল জলবায়ুতে ভালো ফলন দেয়। আদর্শভাবে, গম চাষের জন্য তাপমাত্রা ১৫-২০°C (৫৯-৬৮°F) এর মধ্যে থাকা উচিত। প্রচুর সূর্যালোক এবং শীতল আবহাওয়া গমের বৃদ্ধি এবং উন্নত ফলন নিশ্চিত করে।

 মাটি প্রস্তুতি

 মাটি প্রস্তুতির প্রথম পদক্ষেপ হলো জমি চাষ করা। জমি ভালোভাবে চাষ করতে হবে যাতে মাটির আর্দ্রতা এবং গুণগত মান উন্নত হয়। প্রথমে জমি হাল চাষ করা হয়, এরপর নি্ন্ম স্তরের লাঙল চাষ করা হয় যাতে মাটির স্তর সমান হয়।

 সার প্রয়োগ:

মাটি প্রস্তুতির জন্য সার প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত, প্রতি একর জমিতে ১০-১৫ টন গোবর সার বা কম্পোস্ট প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া, ১০০ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি সুপারফসফেট, এবং ৩০ কেজি মিউরেট অফ পটাশ (এমপিকে) সার প্রয়োগ করা উচিত।

 জমি সমান করা:

চাষের পরে জমি সমান করা উচিত। জমির মাটির স্তর সমান করে এর ওপর কিছুটা মাটি ঢেলে দিতে হবে যাতে বীজ বপন সহজ হয় এবং গাছের বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়।

বীজ নির্বাচন ও বপন

উন্নত জাতের গম বীজ নির্বাচন করা উচিত। ‘ব্রিজ-৩’, ‘বিএসএস-৭’, ‘বিএসএস-৮’, এবং ‘আবাস-৩’ জাতের গম বাংলাদেশে জনপ্রিয়। বীজ অবশ্যই ভাল গুণগত মানের এবং রোগ মুক্ত হওয়া উচিত।

 বীজ প্রস্তুতি:

বীজ নির্বাচনের পরে, বীজ প্রক্রিয়া করা উচিত। সাধারণত বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়, তারপর ছেঁকা ও শুকনো করা হয়। এতে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বাড়ে।

 বপন পদ্ধতি:

গম বপনের সময় সাধারণত অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে হয়। বীজ বপনের জন্য সারের সাথে মিশিয়ে জমিতে বপন করা হয়। গম বপনের জন্য সাধারণত সারি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যেখানে প্রতি সারির মধ্যে ২০-২৫ সেন্টিমিটার দূরত্ব রাখা হয়। বীজের গভীরতা ৩-৫ সেন্টিমিটার হওয়া উচিত।

 সেচ ব্যবস্থাপনা

গম চাষে সেচ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গমের অঙ্কুরোদগমের পর থেকে নিয়মিত সেচ প্রয়োজন। সাধারণত, গমের সেচ তিনটি মূল পর্যায়ে করা হয় – অঙ্কুরোদগমের সময়, গাছের বৃদ্ধির সময়, এবং ফুল আসার সময়। সেচের পরিমাণ ও সময় আবহাওয়া এবং মাটির অবস্থার ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।

 সেচের প্রকার:

গম চাষে ড্রিপ সেচ এবং সাপ্লিমেন্টারি সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। সেচ ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি যেমন মাইক্রো সেচ ব্যবস্থাপনা ও বৃষ্টি কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে।

পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ

 আগাছা গমের উৎপাদনে প্রতিকূল প্রভাব ফেলে। তাই আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য হাল চাষ ও হাত দিয়ে আগাছা তুলে ফেলা উচিত। এছাড়া, আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য ঔষধি কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।

রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ:

গম চাষে রোগ ও পোকা সমস্যা একটি সাধারণ সমস্যা। প্রায়শই দেখা যায় গমের পাতা পঁচা রোগ, গমের ধুলা রোগ, এবং গমের পোকা। রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক কীটনাশক এবং ফাঙ্গিসাইড ব্যবহার করা উচিত। এছাড়াও, রোগ প্রতিরোধী জাতের গম ব্যবহার করতে পারে।

 সার প্রয়োগের সময়সূচি:

গমের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করতে সার প্রয়োগের সময়সূচি বজায় রাখা উচিত। গমের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে সারের প্রয়োজন হয় এবং সেই অনুযায়ী সার প্রদান করতে হবে।

 গম কাটা ও সংগ্রহ

গম সাধারণত ফুল আসার ১২০-১৩০ দিন পর কাটা হয়। গমের কাটা সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ গমের প্রাপ্তি ও উর্বরতা এ সময় নির্ভর করে। গমের কাঁধ কুচি হয়ে গেলে এবং সোনালী রঙ ধারণ করলে কাটা উচিত।

 কাটা প্রক্রিয়া:

গম কাটা সাধারণত ম্যানুয়াল বা মেশিন দ্বারা করা হয়। কাটা গম মাটির উপর রেখে শুকিয়ে নিতে হয়। শুকানোর পর গমের শীষগুলো আলাদা করা হয় এবং ধোয়া হয়।

 সংগ্রহ:

কাটা গমের শস্য সঠিকভাবে পরিষ্কার করা উচিত। তারপর সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা উচিত। গম সংরক্ষণ করার জন্য ভাল বায়ুচলাচল সহ স্থান নির্বাচন করা উচিত যাতে আর্দ্রতা এবং কীটপতঙ্গ সমস্যা কমে যায়।

ফলন বৃদ্ধি কৌশল

 উন্নত ও আধুনিক জাতের বীজ ব্যবহার করা উচিত যাতে ভাল ফলন নিশ্চিত হয়। এই জাতগুলো রোগ ও পোকা প্রতিরোধী এবং অধিক উৎপাদনক্ষম।

সঠিক পরিচর্যা:

বৃদ্ধি পর্যায়ে সঠিক পরিচর্যা এবং সেচ প্রদান করে উৎপাদন বাড়ানো যায়।

আধুনিক প্রযুক্তি:

অধুনিক কৃষি প্রযুক্তি যেমন ড্রিপ সেচ, উন্নত সার ব্যবস্থাপনা এবং রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ কৌশল ব্যবহার করে ফলন বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

মানসম্মত সার ব্যবহারের পদ্ধতি:

সার ব্যবহারের পদ্ধতিতে যত্নবান হওয়া উচিত। সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে যাতে গমের পুষ্টি সঠিক থাকে এবং ফলন বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার

গম চাষ একটি জটিল কিন্তু লাভজনক কৃষি কার্যক্রম। সঠিক মাটি প্রস্তুতি, বীজ নির্বাচন, সেচ ব্যবস্থাপনা, রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণ, এবং সঠিক পরিচর্যা গম চাষের সফলতার চাবিকাঠি। উন্নত প্রযুক্তি এবং আধুনিক কৃষি কৌশল গমের ফলন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে, যা কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক পদ্ধতি ও যত্ন গ্রহণ করে কৃষকরা সফলভাবে গম চাষ করতে সক্ষম হবেন এবং ভালো ফলন অর্জন করতে পারবেন।

শেয়ার করুনঃ