১০টি দেশি বনজ গাছ ও তাদের ঔষধি গুণাগুণ
বনজ গাছ ও আমাদের জীবনে গুরুত্ব
বনজ গাছ আমাদের পরিবেশ ও জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের বনাঞ্চল ও গ্রামীণ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে দেশি বনজ গাছ পাওয়া যায়, যাদের ঔষধি গুণাগুণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এই গাছগুলো শুধু আমাদের পরিবেশকে সুস্থ রাখে না, বরং নানা রোগের প্রতিকারেও সহায়ক। এ কারণে দেশি বনজ গাছের সংরক্ষণ ও সঠিক ব্যবহার আমাদের সকলের জন্য অপরিহার্য।
এই ব্লগে আমরা বাংলাদেশের ১০টি প্রধান দেশি বনজ গাছের পরিচিতি, ব্যবহারযোগ্য অংশ, ঔষধি গুণ এবং ব্যবহারের পদ্ধতি বিস্তারিত আলোচনা করব। আশা করি, এটি আপনাদের ঔষধি গাছের জ্ঞানবৃদ্ধিতে সাহায্য করবে এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ বাড়াবে।
১. নিম (Azadirachta indica)

গাছের পরিচিতি
নিম বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশি বনজ গাছ। এটি উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে প্রধানত জন্মায় এবং তার গাঢ় সবুজ পাতা ও তীক্ষ্ণ গন্ধের জন্য পরিচিত। নিম গাছের উচ্চতা ১৫ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
ব্যবহারযোগ্য অংশ
- পাতা
- ছাল
- বীজ
- ফুল
ঔষধি গুণ
নিমের বিভিন্ন অংশে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-ফাঙ্গাল, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং এন্টি-অক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা যেমন ব্রণ, একজিমা এবং সংক্রমণ নিরাময়ে ব্যবহার হয়। নিমের তেল পোকামাকড় নিরোধক হিসেবেও কার্যকর।
ব্যবহার পদ্ধতি
- নিমের পাতা রস মুখের সংক্রমণ বা গলাব্যথায় গার্গল করতে ব্যবহার করা হয়।
- ছাল থেকে তৈরি কষা ডায়রিয়া ও পেটের অসুখে উপকারী।
- বীজ থেকে তেল তৈরী করে চর্মরোগ ও মাথার খুশকি প্রতিরোধ করা হয়।
সতর্কতা
অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যবহারে কিছু ক্ষেত্রে পেট খারাপ বা এলার্জির সমস্যা হতে পারে। গর্ভবতী মহিলা ও ছোট শিশুদের ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
২. বহেরা (Terminalia bellirica)

গাছের পরিচিতি
বহেরা গাছটি বড় এবং শক্তিশালী বনজ গাছ, যার ফল বড় এবং হালকা বাদামী রঙের। বহেরা ফলের গাছ সাধারণত ২০ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতা পর্যন্ত হয়।
ব্যবহারযোগ্য অংশ
- ফল
- ছাল
ঔষধি গুণ
বহেরা ফল প্রচণ্ড অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি। এটি হজম শক্তি বৃদ্ধি, কাশি ও শ্বাসকষ্টের জন্য ব্যবহৃত হয়। বহেরা ত্বক ও চুলের জন্যও উপকারী।
ব্যবহার পদ্ধতি
- শুকনো বহেরা ফল কষা হিসেবে ব্যবহার করা হয় পেটের গ্যাস ও অম্বল শমনে।
- বহেরা চিবিয়ে দাঁত শক্ত ও মাড়ি সুস্থ রাখা যায়।
সতর্কতা
ডায়াবেটিস রোগীদের বহেরা ব্যবহারে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। দীর্ঘমেয়াদী ও অতিরিক্ত ব্যবহারে পেটের সমস্যার সম্ভাবনা থাকে।
৩. হরিতকি (Terminalia chebula)

গাছের পরিচিতি
হরিতকি একটি বনজ গাছ, যা ছায়াপাতলা এবং স্বাস্থ্যকর ফলের জন্য পরিচিত। এর ফলগুলো ছোট ও কচি বাদামী রঙের হয়। এটি প্রধানত নদী তীরবর্তী বনাঞ্চলে জন্মায়।
ব্যবহারযোগ্য অংশ
- শুকনো ফল
ঔষধি গুণ
হরিতকি বীর্যশুদ্ধি, কিডনি ও লিভারের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক। এটি পাচনতন্ত্রের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ব্যবহৃত হয়। এন্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
ব্যবহার পদ্ধতি
- শুকনো হরিতকি ফল গুড়িয়ে পাউডার করে গরম পানির সাথে মিশিয়ে পান করা হয়।
- আয়ুর্বেদিক ঔষধে হরিতকি প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত।
সতর্কতা
গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীরা হরিতকি ব্যবহারে সতর্ক থাকুন। কিডনি রোগীদের অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
৪. অর্জুন (Terminalia arjuna)

গাছের পরিচিতি
অর্জুন গাছ একটি বড় এবং দীর্ঘজীবী দেশি গাছ, যার ছাল ধূসর ও মসৃণ। এটি নদীর তীরে জন্মাতে পছন্দ করে এবং হৃদরোগের ঔষধি গুণের জন্য বিখ্যাত।
ব্যবহারযোগ্য অংশ
- ছাল
ঔষধি গুণ
অর্জুন ছাল হৃদরোগের জন্য অতি উপকারী। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক এবং রক্তে কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ।
ব্যবহার পদ্ধতি
- অর্জুন ছাল শুকিয়ে পাউডার করে তা গরম পানির সাথে মিশিয়ে পান করা হয়।
- আয়ুর্বেদিক ও হার্বাল ঔষধে অর্জুন ছাল ব্যবহৃত হয় হৃদরোগের জন্য।
সতর্কতা
হৃদরোগ ও রক্তচাপের ঔষধ সেবনের সময় ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। গর্ভবতী নারীরা এটির ব্যবহার এড়ানো উচিত।
৫. আশ্বত্থ/পিপুল (Ficus religiosa)

গাছের পরিচিতি
পিপুল গাছ বাংলার অন্যতম পবিত্র বনজ গাছ। এর পাতা হার্ট আকৃতির এবং এটি বহু বছর বাঁচে। পিপুল গাছের ছাল ও পাতা ঔষধে ব্যবহৃত হয়।
ব্যবহারযোগ্য অংশ
- পাতা
- ছাল
ঔষধি গুণ
পিপুল গাছের পাতা ও ছাল শ্বাসকষ্ট, কাশি ও জ্বর কমাতে সাহায্য করে। এটি অন্ত্রের সমস্যা ও ডায়রিয়ায় উপকারী। এছাড়া রক্তশূন্যতা দূর করে।
ব্যবহার পদ্ধতি
- পাতার রস কাশি ও জ্বরে ব্যবহার করা হয়।
- ছাল থেকে তৈরি কষা ডায়রিয়া ও পেটের রোগে উপকারী।
সতর্কতা
অতিরিক্ত ব্যবহারে পেটের অস্বস্তি হতে পারে। গর্ভবতী নারীরা সাবধান হোন।
৬. তুলসী (Ocimum sanctum)

গাছের পরিচিতি
তুলসী আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অপরিহার্য ঔষধি গাছ। এটি ছোট ও গন্ধযুক্ত পাতাযুক্ত একটি বনজ গাছ, যা প্রায় প্রতিটি বাঙালির ঘরে পাওয়া যায়।
ব্যবহারযোগ্য অংশ
- পাতা
- শিকড়
ঔষধি গুণ
তুলসী রক্তশুদ্ধি, শ্বাসকষ্ট ও জ্বর কমাতে সাহায্য করে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং মানসিক চাপ কমায়। এছাড়া এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি।
ব্যবহার পদ্ধতি
- তুলসী পাতা চিবিয়ে বা রস পান করা হয় ঠাণ্ডা ও কাশি কমানোর জন্য।
- তুলসীর কষা মলদ্বার ও চর্মরোগে প্রয়োগ করা হয়।
সতর্কতা
তুলসী সেবনে সাধারণত কোনো বড় ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, তবে অতিরিক্ত সেবন এড়ানো উচিত।
৭. বাহার/আলতা (Lawsonia inermis)

গাছের পরিচিতি
বাহার গাছটি ছোট ও পাতাযুক্ত, যার পাতা থেকে বিখ্যাত আলতা তৈরি হয়। এটি ত্বকের বিভিন্ন সমস্যার জন্য বহুল ব্যবহৃত ঔষধি গাছ।
ব্যবহারযোগ্য অংশ
- পাতা
- শিকড়
ঔষধি গুণ
বাহার পাতা ত্বকের প্রদাহ কমায়, খুশকি দূর করে এবং চুলের স্বাস্থ্য উন্নত করে। আলতা আঘাত, দগ্ধস্থান এবং চর্মরোগে ব্যবহার করা হয়।
ব্যবহার পদ্ধতি
- পাতা পিষে তৈরি আলতা ক্ষতস্থানে লাগানো হয়।
- শিকড়ের কষা কাশি ও সর্দির জন্য ব্যবহৃত হয়।
সতর্কতা
বাহার ব্যবহারে ত্বকে এলার্জি হতে পারে, তাই আগে ছোট অংশে প্রয়োগ করে পরীক্ষা করা উচিত।
৮. গুলঞ্চ (Tinospora cordifolia)

গাছের পরিচিতি
গুলঞ্চ একটি লতানো বনজ গাছ, যা সাধারণত অন্য গাছের ডালে উঠতে দেখা যায়। এর ডাল ও তনু ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ব্যবহারযোগ্য অংশ
- তনু
- ডাল
ঔষধি গুণ
গুলঞ্চ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, জ্বর কমায় এবং রক্ত পরিষ্কার করে। এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।
ব্যবহার পদ্ধতি
- তনু কেটে শুকিয়ে পাউডার করা হয় এবং গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে পান করা হয়।
- ডালের কষা জ্বর ও সর্দি-কাশিতে কার্যকর।
সতর্কতা
গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীরা গুলঞ্চ ব্যবহারে সতর্ক থাকুন।
৯. ধাতুরি (Datura metel)

গাছের পরিচিতি
ধাতুরি একটি বিষাক্ত বনজ গাছ, যা ছোট গাছের মতো দেখতে। এর ফুল সাদা বা বেগুনি হয় এবং রাতের বেলায় বিশেষভাবে সুগন্ধযুক্ত।
ব্যবহারযোগ্য অংশ
- পাতা
- ফুল
- বীজ
ঔষধি গুণ
ধাতুরি ব্যথানাশক, অ্যান্টি-স্পাজমডিক এবং শ্বাসনালী প্রসারণে সাহায্য করে। এটি সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টে ব্যবহৃত হয়।
ব্যবহার পদ্ধতি
- পাতা বা ফুলের সঠিক মাত্রায় কষা তৈরি করে ব্যবহার করা হয়।
সতর্কতা
ধাতুরি অত্যন্ত বিষাক্ত; এটি কখনোই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করা উচিত নয়। অতিরিক্ত সেবন মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
১০. আমলকি (Phyllanthus emblica)

গাছের পরিচিতি
আমলকি বা আয়বেরি ছোট গাছ, যার ফল সবুজ ও গাঢ় টকাটে স্বাদের। এটি ভিটামিন সি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ।
ব্যবহারযোগ্য অংশ
- ফল
ঔষধি গুণ
আমলকি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, হজম শক্তি বৃদ্ধি করে এবং চর্মরোগে উপকারী। এটি লিভার সুস্থ রাখে এবং শরীরের ক্ষয় রোধ করে।
ব্যবহার পদ্ধতি
- আমলকি ফল কাঁচা বা শুকিয়ে পাউডার করে ব্যবহার করা হয়।
- আয়ুর্বেদিক ও হার্বাল ঔষধে প্রধান উপাদান।
সতর্কতা
অতিরিক্ত সেবন হজমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। গর্ভবতী নারীদের ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
উপসংহার: দেশি গাছের গুরুত্ব ও সংরক্ষণের আহ্বান
আমাদের দেশের ১০টি দেশি বনজ গাছ শুধুমাত্র পরিবেশের জন্য নয়, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার জন্যও অতুলনীয় গুরুত্ব বহন করে। এই গাছগুলো আমাদের রোগ-ব্যাধির প্রতিকার হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি প্রাকৃতিক ঔষধ হিসেবে দেশি গাছের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে স্বাস্থ্য খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।
কিন্তু দ্রুত বর্ধনশীল নগরায়ন ও বনাঞ্চলের হ্রাসের কারণে এসব গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাই আমরা সকলেই এই দেশি বনজ গাছের সঠিক সংরক্ষণ ও চাষাবাদের জন্য সচেতন হতে হবে। শিশুদের মধ্যে প্রাকৃতিক ঔষধের মূল্যবোধ গড়ে তোলা এবং স্থানীয়ভাবে এসব গাছ রোপণের মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও স্বাস্থ্যকে রক্ষা করতে পারি।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
১. দেশি বনজ গাছ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
দেশি বনজ গাছ পরিবেশ সুরক্ষায়, রোগ প্রতিরোধে এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রয়োজনে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এগুলো স্বাস্থ্যকর ও প্রাকৃতিক ঔষধ সরবরাহ করে।
২. ঔষধি গাছ ব্যবহার করার আগে কি ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত?
হ্যাঁ, বিশেষ করে যদি আপনি গর্ভবতী হন, শিশু বা অন্য কোনো গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে থাকেন, তবে যেকোনো ঔষধি গাছের ব্যবহার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৩. দেশি বনজ গাছ গুলো কি সবসময় পাওয়া যায়?
দুর্ভাগ্যবশত, নগরায়ন ও বনাঞ্চল হ্রাসের কারণে কিছু দেশি গাছের সংখ্যা কমছে। তাই এগুলোর সংরক্ষণ জরুরি।
৪. আমি কি আমার ঘরে এসব গাছ লাগাতে পারি?
অবশ্যই, অনেক দেশি গাছ ছোট বাগানে কিংবা পটেও ভালো হয়। তুলসী, পিপুল ও আমলকি সহজে বাড়িতে লাগানো যায়।
৫. ধাতুরি গাছের ব্যবহার কি নিরাপদ?
ধাতুরি অত্যন্ত বিষাক্ত, তাই এটি কখনোই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করা উচিত নয়। অতিরিক্ত ব্যবহারে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। © ২০২৫ দেশি বনজ গাছ ও ঔষধি গুণাগুণ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
