ভুট্টা বা মক্কা একটি গুরুত্বপূর্ণ শস্য যা খাদ্য, পশুখাদ্য, তেল, এবং বায়োগ্যাস উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে ভুট্টা চাষের গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলেছে, বিশেষত হাইব্রিড ভুট্টা চাষের মাধ্যমে কৃষকরা অধিক লাভ পাচ্ছেন। হাইব্রিড ভুট্টা সাধারণত উন্নত জাতের চাষ, যা ভালো ফলন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, এবং দ্রুত বৃদ্ধি সক্ষমতার জন্য পরিচিত। এ নিবন্ধে হাইব্রিড ভুট্টা চাষের পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে, যা কৃষকদের জন্য অত্যন্ত উপকারী হতে পারে।

১. হাইব্রিড ভুট্টা চাষের উপকারিতা

হাইব্রিড ভুট্টার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন:

  • উচ্চ ফলন: হাইব্রিড ভুট্টা সাধারণত ঐতিহ্যগত ভুট্টার চেয়ে বেশি ফলন দেয়।
  • তাড়াতাড়ি পরিপক্বতা: হাইব্রিড জাত দ্রুত পরিপক্ব হয়, ফলে কৃষকরা কম সময়ে ফসল ঘরে তুলতে পারেন।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: হাইব্রিড ভুট্টা অনেক ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধে সক্ষম থাকে, যেমন ব্লাইট, রুট রোট ইত্যাদি।
  • পুষ্টি গুণ: হাইব্রিড ভুট্টার দানায় পুষ্টির ঘনত্ব বেশি থাকে, যা মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে সাহায্য করে।
  • বাজারে চাহিদা: হাইব্রিড ভুট্টার বাজারে চাহিদা বেশি, বিশেষত খাদ্য শিল্প, পশুখাদ্য উৎপাদন, এবং বায়োএনার্জি ক্ষেত্রে।

২. জমি প্রস্তুতি

হাইব্রিড ভুট্টা চাষের জন্য প্রথমে জমি প্রস্তুত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জমি নির্বাচন করার সময় নিচের বিষয়গুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে:

  • মাটি: ভুট্টা চাষের জন্য দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত। মাটি যদি অতিরিক্ত ভারী বা পিচ্ছিল হয়, তবে drainage ব্যবস্থা থাকতে হবে।
  • পিএইচ স্তর: মাটির পিএইচ ৬.০ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে হওয়া উচিত। মাটি যদি অম্লীয় হয়, তবে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
  • জমি পরিমাপ: জমির আগের অবশিষ্ট শস্য বা আগাছা সরিয়ে ফেলতে হবে। জমি ভালোভাবে চিড়ে চিরে মাটির গভীরতা বাড়ানো উচিত। এজন্য মই বা ট্র্যাক্টর ব্যবহার করা যেতে পারে।

জমি প্রস্তুতির পর, মাটি হালকা করে চাষ করতে হবে, যাতে ভুট্টার শিকড় সহজে মাটির মধ্যে প্রবাহিত হতে পারে। এছাড়া, জমি প্রস্তুতির সময় প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করতে হবে।

৩. বীজ বপন

হাইব্রিড ভুট্টা চাষের প্রথম ধাপ হল বীজ বপন। বীজ বপন করার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখতে হবে:

  • বীজ নির্বাচন: বীজ বপনের আগে অবশ্যই ভালো মানের হাইব্রিড বীজ নির্বাচন করা উচিত। বিভিন্ন কোম্পানি এবং গবেষণাগারের পরীক্ষিত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
  • বীজের পরিমাণ: প্রতি একর জমির জন্য সাধারণত ১৫-১৮ কেজি হাইব্রিড বীজ লাগে। তবে, এটি জমির মান এবং গাছের সঠিক ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।
  • বপনের পদ্ধতি: বীজ বপন করার জন্য সাধারণত সারি (row) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি সারির মধ্যে ৭-৮ ইঞ্চি দূরত্ব রেখে বীজ বপন করতে হবে। সারির মধ্যে প্রায় ১৮ ইঞ্চি দূরত্ব রাখা উচিত।
  • গভীরতা: বীজ বপনের গভীরতা সাধারণত ১.৫ থেকে ২ ইঞ্চি হতে হবে। তবে জমির আর্দ্রতা এবং মাটির গঠন অনুসারে গভীরতা সামান্য পরিবর্তিত হতে পারে।

বীজ বপনের পর, জমিতে প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে, যাতে বীজ দ্রুত অঙ্কুরিত হতে পারে।

৪. সার প্রয়োগ

ভুট্টা চাষে সার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক সার প্রয়োগের মাধ্যমে ফসলের বৃদ্ধি বৃদ্ধি এবং ফলন বৃদ্ধি সম্ভব। সাধারণত, হাইব্রিড ভুট্টা চাষে নিম্নলিখিত সার প্রয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়:

  • বীজ বপন সময়: প্রতি একর জমিতে ২৫ কেজি ডিএপি (Diammonium Phosphate), ১০ কেজি ইউরিয়া, এবং ৫ কেজি এমপিও (MOP) প্রয়োগ করতে হবে।
  • গাছের বৃদ্ধির সময়: গাছের বৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য ৫০ কেজি ইউরিয়া এবং ১৫ কেজি এমপিও প্রয়োগ করা যেতে পারে।
  • সারের প্রয়োগ সময়সূচি: সার প্রয়োগের সময়কাল প্রায় তিনটি ধাপে করা হয়—প্রথম সার বপন করার সময়, দ্বিতীয় ২০-৩০ দিনের মধ্যে, এবং তৃতীয় প্রয়োগ ফুল আসার আগে।

সার প্রয়োগের পর সেচ দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৫. সেচ ব্যবস্থা

ভুট্টা একটি পানি প্রিয় শস্য। তেমন কোন বড় খরা হলে ফসলের ফলন কমে যেতে পারে। তাই নিয়মিত সেচ প্রদান করা প্রয়োজন। তবে সেচের পরিমাণ এবং সময়কাল জমির প্রকৃতি এবং আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে।

  • সেচের পরিমাণ: বীজ বপন পরবর্তী ৫-৭ দিন পর সেচ দিতে হবে। গাছের বৃদ্ধি এবং আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে সপ্তাহে ১-২ বার সেচ প্রদান করা যেতে পারে।
  • সেচের পদ্ধতি: ড্রিপ সেচ বা স্প্রিঙ্কলার সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে, যেগুলি পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে এবং গাছের বৃদ্ধি উন্নত করতে সহায়ক।

৬. আগাছা ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ

ভুট্টা চাষের সময় আগাছা ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগাছা এবং পোকামাকড় গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করতে পারে এবং ফলন কমিয়ে দিতে পারে।

  • আগাছা নিয়ন্ত্রণ: প্রথম দিকে আগাছা বেশি দেখা যায়, তাই মেকানিক্যাল উপায়ে বা হাত দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করা উচিত। হালচাষ বা মইয়ের সাহায্যে মাটি গুছিয়ে দিলে আগাছা কমে যায়।
  • রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ: পোকামাকড় যেমন- ধান পোকা, গীলা পোকার আক্রমণ হতে পারে। এগুলোর বিরুদ্ধে টিকাদান, যেমন নিওটিন বা অন্যান্য কীটনাশক স্প্রে করা যেতে পারে। এছাড়া, নিয়মিত গাছের পাতায় কোনো ধরনের ফাঙ্গাস বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ দেখা গেলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেওয়া উচিত।

৭. ফলন সংগ্রহ

ভুট্টার ফসল সংগ্রহের সময় সঠিক হতে হবে, না হলে ফলন কমে যেতে পারে। সাধারণত, হাইব্রিড ভুট্টা ৯০-১২০ দিনের মধ্যে পরিপক্ব হয়ে ওঠে। ফলন সংগ্রহের সময় মক্কা বা ভুট্টার শঙ্কু বা খোসা সাধারণত হলুদ হয়ে যায় এবং শুষ্ক হতে থাকে। তখনই উপযুক্ত সময় ফসল সংগ্রহের জন্য।

ফসল সংগ্রহের পর, ভুট্টার শঙ্কু ভালোভাবে শুকানো উচিত, যাতে এতে থাকা তেল এবং জলীয় উপাদান কমে যায়। এরপর ভুট্টার বীজ সংগ্রহ করে তেল বের করার জন্য প্রস্তুত করা হয়।

৮. লাভজনকতা এবং বাজার

হাইব্রিড ভুট্টা চাষ লাভজনক হতে পারে যদি সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। ভুট্টা থেকে পাওয়া তেল, বীজ, এবং শস্য বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হয়, যার ফলে বাজারে এর চাহিদা থাকে। উৎপাদিত ভুট্টা কৃষকরা বিভিন্ন মিলে বিক্রি করতে পারেন, যেমন পশুখাদ্য, খাদ্যশস্য, এবং তেল শিল্পে।

উপসংহার

হাইব্রিড ভুট্টা চাষ আধুনিক কৃষির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফসল। এর মাধ্যমে কৃষকরা সহজেই বেশি ফলন এবং লাভ পেতে পারেন, যদি সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। জমি প্রস্তুতি, বীজ নির্বাচন, সারের প্রয়োগ, সেচ, আগাছা ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক সময়ে ফলন সংগ্রহ করা ।

শেয়ার করুনঃ