সরিষা (Brassica spp.) হল এক প্রকার তেলবীজ গাছ, যা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ করা হয়। সরিষা প্রধানত তেল উৎপাদনের জন্য পরিচিত, তবে এর পাতা এবং ডাঁটা শাক হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং বিভিন্ন খাদ্য প্রস্তুতিতে এর ব্যবহার রয়েছে। সরিষার তেল ভেষজ চিকিৎসায়ও কাজে লাগে। সরিষা চাষ সহজ, লাভজনক এবং কৃষকদের জন্য একটি জনপ্রিয় ফসল। এটি এমন একটি ফসল যা কম খরচে বেশি ফলন দিতে সক্ষম, এবং এর পরিচর্যা ও চাষ পদ্ধতি খুবই সহজ। এই নিবন্ধে সরিষা চাষের বিস্তারিত পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে, যা কৃষকদের জন্য উপকারী হতে পারে।
১. সরিষা চাষের উপযোগী আবহাওয়া
সরিষা একটি শীতকালীন ফসল, যা সাধারণত ঠান্ডা এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় ভালো জন্মে। সরিষার জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। তাছাড়া, সরিষা সুর্যস্পর্শী গাছ, তবে কিছু পরিমাণ ছায়া থাকলেও এটি ভালোভাবে জন্মাতে পারে। গাছের বৃদ্ধি এবং ফুলের জন্য দিনের আলো বেশি প্রয়োজন। তবে অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া সরিষার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
২. মাটি নির্বাচন
সরিষার জন্য দোআঁশ (loamy) বা বেলে দোআঁশ মাটি সবচেয়ে ভালো। মাটির পিএইচ ৬ থেকে ৭ এর মধ্যে থাকা উচিত, যা সরিষা গাছের জন্য আদর্শ। মাটি যদি অম্লীয় বা ক্ষारी হয়, তাহলে তা সরিষা চাষের জন্য উপযুক্ত নয়। মাটি আগে থেকে ভালভাবে তৈরি করা উচিত, যাতে গাছের শিকড় সহজে মাটির মধ্যে প্রবাহিত হতে পারে। মাটির মধ্যে যেন পানি জমে না থাকে, তার জন্য drainage ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার।
৩. জমি প্রস্তুতি
সরিষা চাষের জন্য জমি প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জমি প্রস্তুতির জন্য প্রথমে আগের ফসলের অবশিষ্টাংশ সরিয়ে ফেলা উচিত। এরপর মাটি ভালোভাবে মই দিয়ে চিড়ে চিরে সুরক্ষিত করা দরকার। মাটি হালকা এবং উর্বর হলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। জমি প্রস্তুতির পর মাটি যদি শুকনো থাকে, তাহলে তা সামান্য সেচ দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। জমি প্রস্তুতির সময় গভীর খুঁটি বা খোলা খালের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে অতিরিক্ত পানি দ্রুত বের হয়ে যায়।
৪. বীজ বপন
সরিষার বীজ সাধারণত সেপ্টেম্বরে বা অক্টোবরের প্রথম দিকে বপন করা হয়, তবে স্থানিক জলবায়ু ও আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে এই সময় পরিবর্তিত হতে পারে। বীজ বপন করার আগে তা ভালোভাবে পরীক্ষণ করে দেখতে হবে যাতে বীজগুলো ভালো এবং কোনো রোগবালাই মুক্ত থাকে। সাধারণত সরিষার বীজ প্রতি হেক্টর জমিতে ৫-৮ কেজি পর্যন্ত লাগে, তবে এটি জমির প্রকারভেদ ও পদ্ধতির উপর নির্ভর করে।
বীজ বপন করার পর ১-১.৫ ইঞ্চি গভীরতায় বীজ পুঁতে দিতে হয়। সরিষা চাষের জন্য বীজ বপনের সময় মনে রাখতে হবে যাতে বীজগুলো একে অপর থেকে কিছুটা দূরত্বে থাকে, সাধারণত ১৫-২০ সেন্টিমিটার। বীজ বপন করার সময় মাঝে মাঝে হালকা সেচ দিতে হবে যাতে বীজ দ্রুত অঙ্কুরিত হয়।
৫. সার প্রয়োগ
সরিষা চাষের জন্য যথাযথ সারের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জমির উর্বরতা অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত, প্রতি হেক্টর জমির জন্য ১০০ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি (ট্রি-পটাশিয়াম ফসফেট), এবং ২৫ কেজি এমপির (এমওপি) সার ব্যবহার করা হয়। বীজ বপনের সময় পূর্ণ পরিমাণ সার প্রয়োগ করা উচিত এবং বর্ধিত গাছের জন্য সারের পরিমাণ সময়মতো বাড়াতে হবে।
সার প্রয়োগের পর গাছের বৃদ্ধি দেখে সারের পরিমাণ ঠিক করতে হবে। বিশেষত, ইউরিয়ার ব্যবহার গাছের বৃদ্ধির জন্য সাহায্যকারী, তবে বেশি সার প্রয়োগে গাছের শিকড়ের ক্ষতি হতে পারে।
৬. সেচ ব্যবস্থা
সরিষা চাষের জন্য সেচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাছের বৃদ্ধি এবং সঠিক ফলন নিশ্চিত করতে নিয়মিত সেচ দেওয়া দরকার, বিশেষত শুকনো মৌসুমে। তবে, সরিষা গাছ অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারে না, তাই জমিতে যেন পানি জমে না যায়, সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। সাধারণত, বীজ বপনের পর প্রথম সপ্তাহে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয় এবং এরপর প্রাকৃতিক বৃষ্টির উপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় সেচ প্রদান করতে হবে।
৭. আগাছা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ
সরিষা গাছ চাষের সময়ে আগাছা এবং রোগ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, সরিষা চাষের প্রথম দিকে আগাছা জন্মে যা গাছের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই গাছের শিকড়ের চারপাশে আগাছা পরিষ্কার করা উচিত। এক্ষেত্রে ম্যানুয়াল পদ্ধতি (হালচাষ, মই দিয়ে) অথবা জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন, পাউডারি মিলডিউ, ডাউন মিলডিউ, পিপড়া ও রেড রুট ইত্যাদি সরিষা গাছে হতে পারে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধি স্প্রে করতে হয়, তবে জৈবিক পদ্ধতিতে কিছু প্রতিকার পদ্ধতি যেমন লবণ পানি স্প্রে, neem oil স্প্রে ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
৮. গাছের পরিচর্যা
গাছের পরিচর্যা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সরিষা গাছের জন্য আদর্শ পানি ও সারের পরিমাণ দেওয়া হলে, গাছ ভালোভাবে বৃদ্ধি পাবে। গাছের বৃদ্ধির সময় তাদের পাতার শাক ভালোভাবে তাজা রাখতে এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে নিয়মিত সার প্রয়োগ করা উচিত। গাছের ডাঁটাতে যাতে কোন ধরনের পোকা বা ছত্রাক আক্রমণ না করে, সেদিকে নজর রাখা উচিত।
৯. ফসল সংগ্রহ
সরিষা ফসল সাধারণত ৩-৪ মাস পর সংগ্রহ করা যায়। সরিষার ফুল ফোটা এবং পরে শঙ্কুর বৃদ্ধি পর্যায় শুরু হলে, এই সময়ে গাছের তেলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফসল সংগ্রহের সঠিক সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেরি করলে শঙ্কুর ফলগুলো শুকিয়ে যেতে পারে বা গাছ থেকে ঝরে পড়তে পারে।
ফসল সংগ্রহের সময় গাছের শঙ্কুর শুস্ক হতে হবে। সাধারণত শঙ্কু যখন সোনালী বা হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং শুকিয়ে যায়, তখনই সঠিক সময় হয়। ফসল সংগ্রহের পরে গাছগুলো ভালোভাবে শুকিয়ে তেল বের করার জন্য প্রস্তুত করা হয়।
১০. তেল উৎপাদন
সরিষা গাছ থেকে তেল প্রাপ্তির জন্য সরিষার শঙ্কু থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হয়। সরিষার বীজগুলো একে একে সংগ্রহ করে ভালোভাবে শুকানো উচিত। শুকানোর পর, বীজগুলোতে থাকা তেল বের করার জন্য ভালো মানের তেল মেশিন ব্যবহার করতে হবে। তেলটি সরাসরি ব্যবহৃত হতে পারে, অথবা খাদ্য প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
উপসংহার
সরিষা চাষ একটি লাভজনক কৃষি কার্যক্রম হতে পারে যদি সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। সরিষা চাষের জন্য সঠিক সময়, সঠিক মাটি, সঠিক সেচ এবং পরিচর্যার মাধ্যমে কৃষকরা ভালো ফলন পেতে পারে। এটি একটি শীতকালীন ফসল, যা কৃষকদের জন্য কম খরচে ভালো লাভ প্রদান করতে সক্ষম। কৃষকরা যদি সরিষা চাষের জন্য প্রয়োজনীয় যত্ন এবং পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তবে তাদের উপার্জন বাড়াতে এটি একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।