লিচু বাগানে পাখি, বাদুড় তাড়ানোর উপায়

লিচু বাগানে পাখি ও বাদুড় প্রতিরোধে জালের ব্যবহার ও অন্যান্য কার্যকর উপায়

ভূমিকা

বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও লাভজনক মৌসুমি ফল হচ্ছে লিচু। সুস্বাদু, রসাল ও পুষ্টিকর এই ফল দেশের নানা অঞ্চলে চাষ হয়, বিশেষত দিনাজপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, পঞ্চগড়, মেহেরপুর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে লিচুর বাণিজ্যিক উৎপাদন লক্ষণীয়। তবে লিচু উৎপাদনের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ফল পাকতে শুরু করলে পাখি ও বাদুড়ের আক্রমণ। তারা লিচু খেয়ে ফলন নষ্ট করে দেয়, যা কৃষকের আর্থিক ক্ষতির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এই সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে জাল ব্যবহার। এছাড়াও কিছু সহায়ক কৌশল যেমন শব্দ/আলো দিয়ে তাড়ানো, ভয় প্রদর্শন করা, জীবাণুনাশক স্প্রে ব্যবহার ইত্যাদিও কার্যকর হতে পারে। এই রচনায় আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো কীভাবে লিচু বাগানে পাখি ও বাদুড় প্রতিরোধে জাল এবং অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।

#পাখি ও বাদুড়ের আক্রমণ কেন হয়?

লোভনীয় পাকা ফল

পাখি যেমন শালিক, কাক, দোয়েল ও টিয়া এবং বাদুড়েরা পাকা ও আধা-পাকা লিচুতে আকৃষ্ট হয়। তারা দলবদ্ধভাবে গাছে বসে ফল খায় এবং অনেক সময় পাতা ও ডালও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বিকালের দিকে সক্রিয়তা বেশি

পাখি সকাল ও বিকালে এবং বাদুড় সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে সক্রিয় হয়। তাই এই সময়ে তাদের তাড়ানোর বিশেষ ব্যবস্থা রাখা দরকার।

##ব্যবহার — সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি

➤ ব্যবহারের পদ্ধতি:

  • গাছের চারপাশে একাধিক দিক থেকে জাল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
  • এমনভাবে ঢাকতে হবে যেন পাখি বা বাদুড় জালের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে।
  • ফুল আসার সময় নয়, ফল আসা শুরু হলে জাল লাগাতে হবে।

➤ কোন ধরনের জাল ভালো?

  • পলিপ্রোপিলিন বা নাইলনের তৈরি হালকা ও টেকসই জাল
  • জালের ফাঁক ১-১.৫ সেমি (ছোট ফাঁক হলে পাখি আটকাবে)
  • কালো বা সবুজ রঙের জাল ব্যবহার ভালো (আলো প্রতিফলনে বিভ্রান্তি কম হয়)

➤ সুবিধা:

  • পাখি এবং বাদুড়ের সরাসরি আক্রমণ থেকে ফল রক্ষা পায়
  • রাসায়নিক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না
  • পরিবেশবান্ধব ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান

➤ অসুবিধা:

  • প্রাথমিক ব্যয় বেশি (প্রতি গাছে ২০০-৫০০ টাকা খরচ হতে পারে)
  • বাতাস ও আলো চলাচলে কিছুটা বাধা হতে পারে

###পাখি তাড়ানোর অন্যান্য উপায়

ভয় দেখানোর ব্যবস্থা

➤ কাকতাড়ুয়া

  • খালি জামা-কাপড় দিয়ে মানুষ সদৃশ কাঠামো তৈরি করে মাঠে বসানো হয়
  • মাঝে মাঝে অবস্থান ও পোশাক বদলালে বেশি কার্যকর হয়

➤ চকচকে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল বা সিডি ডিস্ক

  • আলো পড়লে প্রতিফলন হয়ে পাখি বিভ্রান্ত হয়
  • গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখলে ফল দেয় ভালো

➤ প্লাস্টিকের হিংস্র পাখির মডেল (বাজপাখি)

  • টিয়া বা ছোট পাখিরা ভয় পেয়ে গাছে বসে না
  • মাঝে মাঝে স্থান বদলালে কার্যকারিতা বজায় থাকে

শব্দ ব্যবস্থাপনা

➤ শব্দ বোমা

  • টিন বা ব্যারেল পেটানো, পটকা ফাটানো
  • পাখি ভয় পেয়ে পালায়
  • কিন্তু এটা সীমিত সময় কাজ করে

➤ রেডিও বা উচ্চ আওয়াজের শব্দ চালানো

  • ভোর ও সন্ধ্যায় কিছু সময় জোরে শব্দ চালানো যায়
  • পাখিরা বিরক্ত হয়ে আসে না

####বাদুড় তাড়ানোর কার্যকর উপায়

আলো ও আলোচিত্র ব্যবহার

➤ LED বা সোলার লাইট

  • গাছে লাল/নীল আলো লাগানো হলে বাদুড় ধরা পড়ে না
  • চলন্ত আলো ব্যবহারে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়

➤ ফ্ল্যাশ লাইট ও সোলার রিফ্লেক্টর

  • আলো ঘোরানো হলে বাদুড় ভয় পায়
  • গাছের নিচে বা ডালের পাশে বসাতে হয়

শব্দ ও অতিস্বনক যন্ত্র

  • কিছু যন্ত্র থাকে যা অতিস্বনক তরঙ্গ ছড়ায়
  • বাদুড়েরা এই তরঙ্গ সহ্য করতে না পেরে চলে যায়
  • দাম একটু বেশি হলেও লিচু বাগানের জন্য কার্যকর বিনিয়োগ

১ নিম তেল বা গন্ধযুক্ত স্প্রে

  • পাখি ও বাদুড় গন্ধ সহ্য করতে পারে না
  • গাছের চারপাশে স্প্রে করা হলে আক্রমণ কমে

২ বায়োলজিকাল রিপেলেন্ট

  • কিছু বায়োস্প্রে (তুলসী, রসুনের নির্যাস ইত্যাদি) ব্যবহার করা হয়
  • এটি পাখিদের আকর্ষণ কমায়

সমন্বিত পদ্ধতি

শুধু জাল বা শব্দ নয় — সমন্বিত পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর:

  • ফল আসার সময় জাল ব্যবহার
  • বিকালে রেডিও বা শব্দ চালানো
  • রাতে লাইট জ্বালানো
  • মাঝে মাঝে স্প্রে বা রিপেলেন্ট ব্যবহার
  • কাকতাড়ুয়া বা ভয়ের ব্যবস্থা

এতে করে পাখি ও বাদুড় একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণে থাকে।

খরচ ও লাভের তুলনা

উপায়আনুমানিক খরচ (প্রতি গাছে)কার্যকারিতাদীর্ঘস্থায়ী ফল
জাল২০০-৫০০ টাকা৯০%৩-৫ বছর
কাকতাড়ুয়া১০০-২০০ টাকা৫০%১-২ মাস
শব্দ/আলো৩০০-১০০০ টাকা৭০%১ মৌসুম
স্প্রে৫০-১০০ টাকা৩০%অস্থায়ী

উৎপাদনের ১৫-২৫% ফল সাধারণত নষ্ট হয় পাখি ও বাদুড়ে। তাই জাল লাগানো হলে তা প্রতিহত হয়ে কৃষকের মোট লাভ অনেক বেড়ে যায়।

উপসংহার

লিচু চাষে পাখি ও বাদুড়ের আক্রমণ একটি বড় সমস্যা হলেও জাল ব্যবহার ও সহায়ক কৌশল প্রয়োগ করে তা সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। আজকাল অনেক কৃষকই সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করছেন, যাতে তারা পরিবেশবান্ধব ও লাভজনকভাবে ফল উৎপাদন করতে পারেন। জাল ব্যবহারের মাধ্যমে ৯০% পর্যন্ত ফল রক্ষা করা সম্ভব, এবং এই পদ্ধতিটি একবার ইনভেস্টমেন্ট করলেই ৩-৫ বছর ব্যবহারযোগ্য।

বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য এ পদ্ধতি শুধু লাভজনক নয়, বরং লিচু রপ্তানি সক্ষমতাও বাড়ায়। তাই সঠিক সময়ে সঠিক উপায়ে জাল ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা ভবিষ্যতের চাষাবাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শেয়ার করুনঃ