বারোমাসি সবজি তালিকা ও চাষপদ্ধতি: ১২ মাসের সবজি চাষের সম্পূর্ণ গাইড
বাংলাদেশের উর্বর মাটি ও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে বারো মাসই বিভিন্ন সবজি চাষ করা সম্ভব। সঠিক মৌসুমে উপযুক্ত ফসল নির্বাচন ও পরিচর্যার মাধ্যমে কৃষকরা সারা বছর সবজি উৎপাদন করতে পারেন। এই পোস্টে প্রতিমাসে উপযুক্ত সবজি তালিকা, চাষপদ্ধতি, সার ব্যবহার, রোগ দমন, বাজারজাতকরণ এবং বারোমাসি চাষের পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
জানুয়ারি মাসে চাষযোগ্য সবজি
মূলা
গাজর
বাঁধাকপি
ফুলকপি
ব্রকলি
টমেটো
লেটুস
চাষ পদ্ধতি (টমেটোর উদাহরণ):
উঁচু ও মাঝারি দোআঁশ মাটি টমেটোর জন্য উপযুক্ত।
বীজতলা থেকে ২৫-৩০ দিনের চারা জমিতে রোপণ করতে হবে।
প্রতি গাছে ৫–৭ টি পর্যন্ত ফল ধরে।
রোগ প্রতিরোধে ট্রাইকোডার্মা ও কপার অক্সিক্লোরাইড ব্যবহার করা যায়।
ফেব্রুয়ারি মাসে চাষযোগ্য সবজি
করলা
শিম
কুমড়ো
চিচিঙ্গা
ঝিঙে
বাঁধাকপি (শেষ পর্যায়)
চাষ পদ্ধতি (করলার জন্য):
হাইব্রিড করলার জাত যেমন “Green Star” ভালো ফলন দেয়।
প্রতি গর্তে ২-৩টি করে বীজ বপন করা উচিত।
লতাজাতীয় বলে মাচা তৈরি আবশ্যক।
পোকা দমনে ইমিডাক্লোপ্রিড ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
মার্চ মাসে চাষযোগ্য সবজি
লাউ
ঝিঙে
ঢেঁড়স
করলা
কুমড়ো
পুঁই শাক
ঢেঁড়স চাষ পদ্ধতি:
সরাসরি বীজ বপন করা হয়।
চাষের ৪০-৫০ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহযোগ্য হয়।
গাছ বড় হলে মাচা ছাড়াও ভালো ফলন পাওয়া যায়।
এপ্রিল মাসে চাষযোগ্য সবজি
পুঁই শাক
লাল শাক
ঢেঁড়স
কাঁচা মরিচ
করলা
চিচিঙ্গা
কাঁচা মরিচ চাষ:
বীজতলা থেকে ৩০-৩৫ দিনের চারা রোপণ করতে হয়।
প্রতি শতাংশে ফলন ১৫-২০ কেজি পর্যন্ত হয়।
ছত্রাক রোগ থেকে রক্ষা পেতে নিয়মিত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হয়।
১ মাস পর ফলন শুরু হয়, ৩ মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়।
সেপ্টেম্বর মাসে চাষযোগ্য সবজি
শিম
মুলা
শালগম
পালং শাক
লাল শাক
টমেটো (বীজতলা)
মুলা চাষ পদ্ধতি:
সরাসরি বীজ বপন করতে হয়।
৩-৫ দিনেই চারা গজায়।
প্রতি শতকে ৩–৪ কেজি ফলন পাওয়া যায়।
পানি জমতে না দেওয়াই উত্তম।
অক্টোবর মাসে চাষযোগ্য সবজি
ফুলকপি
বাঁধাকপি
গাজর
পেঁয়াজ
রসুন
টমেটো (চারা রোপণ)
ফুলকপি চাষ পদ্ধতি:
ঠান্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ভালো জন্মে।
চারা বপনের ২৫–৩০ দিনের মধ্যে মূল জমিতে রোপণ করতে হয়।
সার হিসেবে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ব্যবহার করতে হয়।
ডাউনি মিলডিউ দমনে ছত্রাকনাশক স্প্রে প্রয়োজন।
নভেম্বর মাসে চাষযোগ্য সবজি
গাজর
পালং শাক
বাঁধাকপি
রসুন
শালগম
লেটুস
গাজর চাষ পদ্ধতি:
নরম দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী।
সরাসরি বীজ বপনের ৮০–৯০ দিনে ফসল সংগ্রহযোগ্য।
পর্যাপ্ত সেচ দিতে হবে কিন্তু পানি জমে থাকলে ফল খারাপ হয়।
ডিসেম্বর মাসে চাষযোগ্য সবজি
বাঁধাকপি
ফুলকপি
গাজর
মূলা
লেটুস
পালং শাক
পালং শাক চাষ পদ্ধতি:
ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ভালো জন্মে।
৭-১০ দিনের মধ্যেই শাক কাটার উপযোগী হয়।
প্রতি শতকে গড়ে ১০–১২ কেজি শাক পাওয়া যায়।
সার ব্যবস্থাপনা: সবজিভেদে পরিমাণ (প্রতি শতকে)
সবজির নাম
ইউরিয়া (গ্রাম)
টিএসপি (গ্রাম)
এমওপি (গ্রাম)
গোবর (কেজি)
টমেটো
৩০০
২৫০
২০০
৫–৭
লাউ
৩৫০
৩০০
২৫০
১০
ফুলকপি
৪০০
৩৫০
৩০০
৭
ঢেঁড়স
২০০
১৫০
১৫০
৫
সাধারণ রোগ ও পোকামাকড় দমন
রোগ/পোকার নাম
লক্ষণ
প্রতিকার
জাবপোকা
পাতা কুঁকড়ে যায়, হলুদ হয়
ইমিডাক্লোপ্রিড ১ মি.লি./লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে
ফল ছিদ্রকারী পোকা
ফলে গর্ত দেখা যায়
ট্রাইজোফস ১.৫ মি.লি./লিটার স্প্রে
ডাউনি মিলডিউ
পাতায় হলুদ ছোপ
রিডোমিল গোল্ড প্রতি ১০ দিন পরপর স্প্রে
ছত্রাকজনিত পাতা পঁচা
পাতা গলে যায়
ম্যানকোজেব স্প্রে
বারোমাসি সবজি পরিকল্পনার ক্যালেন্ডার
মাস
প্রধান সবজি
জানুয়ারি
মূলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি
ফেব্রুয়ারি
টমেটো, করলা, শিম
মার্চ
ঢেঁড়স, লাউ, পুঁই শাক
এপ্রিল
পুঁই, কাঁচা মরিচ, ঝিঙে
মে
কলমি শাক, কচু, লাউ
জুন
শিম, করলা, চিচিঙ্গা
জুলাই
লতি কচু, ঢেঁড়স, লাউ
আগস্ট
বরবটি, পেঁয়াজ পাতা, কচু
সেপ্টেম্বর
মুলা, শালগম, পালং শাক
অক্টোবর
ফুলকপি, বাঁধাকপি, রসুন
নভেম্বর
গাজর, পালং, শালগম
ডিসেম্বর
লেটুস, গাজর, মূলা
বাজারজাতকরণ ও লাভ বিশ্লেষণ
বারোমাসি সবজি চাষের ফলে সারা বছর বিক্রির সুযোগ থাকে।
পাইকারি বাজারে সরবরাহ করলে খরচ কম হয়।
নিজস্ব পরিবহন থাকলে লাভের পরিমাণ ২৫–৪০% বাড়ে।
এক বিঘা জমিতে বারোমাসি চাষ করে বছরে গড়ে ১.৫–২ লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব।
🔚
বারোমাসি সবজি চাষ কেবল একটি কৃষি পদ্ধতি নয়, বরং এটি একটি লাভজনক পরিকল্পনা। সঠিক সময়ে সঠিক সবজি নির্বাচন, জমি প্রস্তুতি, সার প্রয়োগ এবং বাজার সংযোগের মাধ্যমে একজন কৃষক বছরে বারো মাসই সবজি চাষ করে পরিবারের জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভালো আয়ও করতে পারেন। এই গাইড অনুসরণ করে আপনি ছোট থেকে বড় যেকোনো আকারে বারোমাসি সবজি চাষ শুরু করতে পারেন।