বাংলাদেশে কৃষির বৈচিত্র্য আনতে এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য আরব দেশীয় খেজুর গাছ চাষ একটি সম্ভাবনাময় উদ্যোগ। খেজুরের বিভিন্ন জাত যেমন বারহি, আজওয়া, মজাফতি, সুক্কারি, খালাস ইত্যাদি দেশে সাফল্যের সাথে চাষ করা সম্ভব। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে এটি অর্থনৈতিকভাবে কৃষকদের জন্য লাভজনক হতে পারে।
খেজুর গাছ চাষের উপযোগী পরিবেশ ও মাটি
আবহাওয়া:
- উষ্ণ ও শুষ্ক জলবায়ু খেজুর চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো।
- ২৫-৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় খেজুর গাছ ভালো জন্মায়।
- স্বল্প বৃষ্টিপাত অঞ্চল খেজুরের জন্য উপযুক্ত, তবে বাংলাদেশে এটি নিয়ন্ত্রিত সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে চাষ করা সম্ভব।
মাটি:
- বেলে-দোআঁশ মাটি সবচেয়ে ভালো।
- পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
- লবণাক্ত ও জলাবদ্ধ মাটি উপযুক্ত নয়।

উন্নত জাতের নির্বাচন
বাজারে অনেক ধরনের আরব দেশীয় খেজুর পাওয়া যায়, তবে চাষের জন্য নিচের জাতগুলো বাংলাদেশে সফলভাবে চাষযোগ্য:
- বারহি (Barhi): রসালো ও মিষ্টি, দ্রুত ফল ধরে।
- আজওয়া (Ajwa): স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, দাম বেশি।
- মজাফতি (Mazafati): নরম ও সুস্বাদু, রমজান মাসে চাহিদা বেশি।
- সুক্কারি (Sukkari): মিষ্টি ও শুষ্ক পরিবেশের জন্য উপযোগী।
- খালাস (Khalas): মধ্যপ্রাচ্যে জনপ্রিয় ও বাংলাদেশে চাষ উপযোগী।
চারা রোপণ ও গাছের পরিচর্যা
বীজ ও চারা সংগ্রহ
- টিস্যু কালচার করা চারা সবচেয়ে ভালো।
- নার্সারিতে প্রস্তুত চারা বা অফসেট চারা রোপণ করতে পারেন।
- চারা রোপণের আগে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে দ্রুত গজায়।
গর্ত তৈরি ও মাটির প্রস্তুতি
- গর্তের মাপ: ৩-৪ ফুট গভীর, ৩-৪ ফুট চওড়া।
- মাটির মিশ্রণ: ৫০% দোআঁশ মাটি, ২৫% কম্পোস্ট সার, ১৫% বালু, ১০% ছাই।
- প্রতিটি গর্তে ১০০-১৫০ গ্রাম ফসফেট সার ও ৫০-১০০ গ্রাম জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে।
চারা রোপণের সময় ও পদ্ধতি
- বর্ষার শেষে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) এবং গ্রীষ্মের শুরুতে (মার্চ-এপ্রিল) রোপণ উপযুক্ত।
- চারা রোপণের পর পর্যাপ্ত পানি দিতে হবে।
- প্রথম ২ সপ্তাহ ছায়ায় রাখতে হবে।
সেচ ও সার প্রয়োগ
সেচ ব্যবস্থাপনা
- গরমকালে ৩-৪ দিন পর পর সেচ দিতে হবে।
- বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি অপসারণ করতে হবে।
- জলাবদ্ধতা এড়াতে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন।
সার ব্যবস্থাপনা
- বছরে ২-৩ বার জৈব সার ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
- প্রতি বছর ৫-১০ কেজি গোবর সার বা ভার্মি কম্পোস্ট প্রয়োগ করুন।
- নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশ সমন্বিত সার প্রয়োগ করুন।
রোগবালাই ও প্রতিকার
সাধারণ সমস্যা ও প্রতিকার
- লাল পোকা: কীটনাশক ব্যবহার করুন।
- পাতা মোড়ানো রোগ: আক্রান্ত পাতা ছেঁটে ফেলুন।
- ছত্রাকজনিত সমস্যা: ছত্রাকনাশক স্প্রে করুন।
- গোড়া পচা রোগ: ভালো পানি নিষ্কাশন নিশ্চিত করুন।

ফুল ও ফল ধরার প্রক্রিয়া
- সাধারণত ৩-৪ বছরের মধ্যে গাছে ফুল আসে।
- পুরুষ ও স্ত্রী গাছ থাকলে কৃত্রিম পরাগায়ন প্রয়োজন।
- কৃত্রিম পরাগায়নের মাধ্যমে ফলন বাড়ানো যায়।
- পরাগায়ন ১-২ দিনের মধ্যে করতে হয়।
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
ফসল সংগ্রহের সময়
- বারহি খেজুর কাঁচা ও পাকা দুইভাবেই খাওয়া যায়।
- ফল পরিপক্ব হলে হলুদ বা লালচে হয়ে যায়।
- সাধারণত ৫-৬ মাসের মধ্যে ফল সংগ্রহযোগ্য হয়।
সংরক্ষণ পদ্ধতি
- খেজুর শুকানোর জন্য রোদে রাখতে হবে।
- হিমাগারে সংরক্ষণ করলে দীর্ঘদিন ভালো থাকে।
- বাজারজাত করার জন্য উপযুক্ত প্যাকেজিং করতে হবে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
- বাংলাদেশে খেজুরের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
- বিদেশ থেকে আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি প্রয়োজন।
- উন্নত চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করলে ভালো মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
উপসংহার
বাংলাদেশে আরব দেশীয় খেজুর গাছ চাষ অত্যন্ত লাভজনক এবং কৃষকদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। সঠিক পরিচর্যা ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চ ফলন পাওয়া সম্ভব। কৃষকদের উচিত এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা এবং সরকারি সহায়তা গ্রহণ করে বড় পরিসরে খেজুর চাষ শুরু করা।