পাট চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল, যা বিশেষত বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। তাই পাটকে সোনালী আঁশ বলা হয় এটি প্রধানত দুটি প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং । পাট চাষের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে ফলন ভালো হয় এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। নিচে পাট চাষের বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো।

. পাটের বৈজ্ঞানিক নাম প্রজাতি

পাট মূলত দুটি প্রজাতির হয়ে থাকে, যা হলো:

  •  (সাদা পাট)
  •  (তোষা পাট)

প্রত্যেক প্রজাতির পাটের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সাদা পাট সাধারণত লবণাক্ত এবং পানি জমে থাকে এমন জমিতে ভালো হয়। অন্যদিকে তোষা পাট উঁচু এবং সুনিষ্কাশিত মাটিতে ভালো হয়।

. পাট চাষের জমি নির্বাচন

পাট চাষের জন্য দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত। মাটির pH মান ৬.৫ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে হলে পাট ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়। উঁচু, মাঝারি উঁচু, এবং নিম্নাঞ্চলে পাট চাষ করা যেতে পারে। তবে, জলাবদ্ধ জমিতে চাষ করতে হলে ভালো নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকতে হবে।

. মাটির প্রস্তুতি

মাটির প্রস্তুতি পাট চাষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। জমি ভালোমতো চাষ দিয়ে নরম ও ঝুরঝুরে করতে হবে। জমির আগাছা, পাথর এবং অন্যান্য অবাঞ্ছিত জিনিসপত্র পরিষ্কার করে নিতে হবে। মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করতে জৈবসার প্রয়োগ করা উচিত। চাষের জন্য প্রতি হেক্টরে ৮-১০ টন গোবর সার বা কম্পোস্ট প্রয়োগ করা যেতে পারে। এর পর মাটি চাষ করে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।

. বীজ নির্বাচন এবং বপন

পাটের উচ্চ ফলনশীল জাত বেছে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। বপনের আগে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা পরীক্ষা করে নিতে হবে। সাধারণত প্রতি হেক্টরে ৫-৭ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। পাটের বীজ বপনের সময় সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে হয়, যখন মাটি পর্যাপ্ত আর্দ্র থাকে। বীজ বপনের জন্য ছিটিয়ে বা সারি পদ্ধতিতে বপন করা যায়। সারি পদ্ধতিতে বপনের ক্ষেত্রে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সেন্টিমিটার রাখা উচিত এবং বীজের গভীরতা ২-৩ সেন্টিমিটার হওয়া উচিত।

. সেচ ব্যবস্থা

পাট চাষের জন্য সেচ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চারা গজানোর পর মাটি শুকিয়ে গেলে প্রথম সেচ দিতে হয়। এরপর ১৫-২০ দিনের ব্যবধানে সেচ দিতে হবে। পাট চাষের সময় বৃষ্টি হলে সেচের প্রয়োজন কম হয়। তবে, জলাবদ্ধতা পাটের জন্য ক্ষতিকর, তাই সেচের পর পানি যাতে জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

. আগাছা নিয়ন্ত্রণ

পাটের ভাল ফলনের জন্য জমির আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। চারা গজানোর ২০-২৫ দিনের মধ্যে প্রথম নিড়ানি দিতে হবে এবং দ্বিতীয় নিড়ানি ৪০-৫০ দিনের মধ্যে দিতে হবে। আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য হাতের কাজে নিড়ানি দেওয়া যেতে পারে, অথবা নির্দিষ্ট আগাছানাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে।

. সার প্রয়োগ

পাট চাষে সারের সঠিক পরিমাণ এবং সময়মতো প্রয়োগ ফলন বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত প্রতি হেক্টরে ৭০-৮০ কেজি নাইট্রোজেন, ৩০-৪০ কেজি ফসফরাস, এবং ২০-৩০ কেজি পটাশ প্রয়োগ করা হয়। এর মধ্যে অর্ধেক নাইট্রোজেন, সম্পূর্ণ ফসফরাস, এবং পটাশ শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হয়। বাকি নাইট্রোজেন ৩০-৪০ দিন পরে প্রয়োগ করতে হবে।

. রোগ পোকা দমন

পাট চাষে বিভিন্ন রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। সাধারণত পাটে পাতামোড়ানো রোগ, কান্ড পচা রোগ, এবং শিকড় পচা রোগ দেখা যায়। এছাড়া বিছা পোকা, মাকড় পোকা, এবং চুড়া পোকা আক্রমণ করতে পারে। এ সব রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ রোধে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করতে হবে। প্রয়োজনে কৃষিবিদের পরামর্শ নিয়ে কীটনাশক এবং ফাংগিসাইড প্রয়োগ করতে হবে।

. পাট কাটার সময় পদ্ধতি

পাট কাটার সঠিক সময় নির্ভর করে ফসলের পরিপক্কতার উপর। সাধারণত বীজ বপনের ১০০-১২০ দিন পর পাট কাটা উপযুক্ত। যখন পাটের তলদেশের পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং ঝরতে শুরু করে, তখন পাট কাটার সময় হয়। পাট কাটার পর এগুলোকে ২-৩ দিনের জন্য মাঠে রেখে শুকাতে দেওয়া হয়। এরপর এগুলোকে পানিতে পচানোর জন্য ডোবায় বা পুকুরে রাখা হয়। পচানোর সময় সাধারণত ১০-১৫ দিন, যা পরিবেশের উপর নির্ভর করে কম-বেশি হতে পারে।

১০. পাটের আঁশ সংগ্রহ

পাট পচানোর পর আঁশ ছাড়ানোর কাজ করা হয়। এটি সাধারণত হাতের সাহায্যে করা হয়। আঁশ ছাড়ানোর পর পাটের আঁশগুলোকে ভালোমতো ধুয়ে নেওয়া হয় এবং রোদে শুকানো হয়। শুকানোর পর আঁশগুলোকে গুছিয়ে সংরক্ষণ করা হয়।

১১. পাটের পরবর্তী যত্ন

পাট কাটার পর জমিতে পাটের গাছের অবশিষ্টাংশ মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এটি জমির জৈব পদার্থ বাড়ায় এবং পরবর্তী ফসলের জন্য মাটি প্রস্তুত করতে সহায়ক হয়।

১২. পাটের বাণিজ্যিক ব্যবহার

পাটের আঁশ থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বস্তা, রশি, কার্পেট, এবং শিল্পজাত পণ্য। পাটের পাতা ও গাছ পশুখাদ্য এবং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া পাটের বীজ থেকেও তেল উৎপাদন করা যায়।

উপসংহার

পাট চাষ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে পাটের ফলন ভালো হয় এবং কৃষকরা লাভবান হন। আধুনিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাটের উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব। এজন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।

শেয়ার করুনঃ