ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশের জীবিকা নির্ভর করে ধান চাষের ওপর। ধান চাষের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে কৃষকরা উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারেন, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক। নিচে ধান চাষের বিভিন্ন ধাপ ও পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ভূমিকা
ধান চাষ বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। ধান চাষে জলবায়ু, মাটি, বীজ নির্বাচন, চারা রোপণ, সার প্রয়োগ, সেচ, আগাছা নিয়ন্ত্রণ, পোকামাকড় ও রোগ নিয়ন্ত্রণ, এবং ধান কাটা ও সংগ্রহ সব কিছুই সঠিকভাবে পরিচালনা করা গুরুত্বপূর্ণ। এই সকল পদক্ষেপ সঠিকভাবে অনুসরণ করলে ধান চাষে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
ধানের প্রকারভেদ
ধান প্রধানত তিন ধরনের হয়:
১) আউশ: এই ধান চাষ সাধারণত গ্রীষ্মকালে হয়, অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের মধ্যে
২) আমন: আমন ধান সাধারণত বর্ষাকালে চাষ করা হয়, যা জুলাই থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে হয়।
৩) বোরো: বোরো ধান শীতকালে চাষ করা হয়, যা ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে হয়।
ধান চাষের উপযোগী আবহাওয়া
ধান একটি উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার ফসল। ধানের ভালো ফলনের জন্য ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। তবে, ধানের জন্য সেরা তাপমাত্রা ২৭ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ধানের চারা রোপণের সময় তাপমাত্রা কিছুটা কম হওয়া ভালো, কিন্তু ধানের ফুল ও বীজ গঠনের সময় তাপমাত্রা বেশি হওয়া দরকার। ধানের সঠিক বৃদ্ধির জন্য ১৫০০ থেকে ২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত প্রয়োজন হয়।
মাটির ধরন
ধান চাষের জন্য বেলে-দোআশ, পলি মাটি, এবং দো-আঁশ মাটি উপযোগী। মাটির পিএইচ স্তর ৫.৫ থেকে ৬.৫ হওয়া উচিত। মাটি যদি বেলে হয়, তবে এটি দ্রুত পানি নিষ্কাশন করে, যা ধানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এজন্য মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা ভালো হওয়া প্রয়োজন। ধান চাষের আগে মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যোগ করা উচিত।
বীজ নির্বাচন
ভালো ফলনের জন্য উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং স্থানীয় জলবায়ুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বীজ নির্বাচন করা উচিত। ধান বীজ বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে, যেমন হাইব্রিড বীজ, উন্নত জাতের বীজ ইত্যাদি। সঠিক বীজ নির্বাচন ধান চাষের সফলতার মূল চাবিকাঠি।
বীজ শোধন
বীজ শোধন ধান চাষে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এতে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং রোগবালাই থেকে বীজকে রক্ষা করা যায়। বীজ শোধনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে, যেমন:
- গরম পানিতে শোধন: বীজকে ৫০-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরম পানিতে ১০-১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখা হয়।
- রাসায়নিক শোধন: বিভিন্ন ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করা হয়।
বীজতলা তৈরি
ধানের বীজতলা তৈরি করা ধান চাষের প্রথম ধাপ। বীজতলার মাটি ভালোভাবে প্রস্তুত করা দরকার, যাতে চারার বৃদ্ধি সঠিকভাবে হয়। বীজতলা সাধারণত ১ মিটার চওড়া এবং যেকোনো দৈর্ঘ্যের হতে পারে। জমির পানি নিষ্কাশনের সুবিধার জন্য বীজতলা সামান্য উঁচু করে বানানো হয়।
বীজ বপন পদ্ধতি:
- বীজতলায় বীজ ছিটিয়ে বপন করতে হবে।
- বীজ বপনের পর ১ সেন্টিমিটার পরিমাণ মাটি অথবা জৈব সার দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
- বীজতলায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে, যাতে মাটি আর্দ্র থাকে।
- বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর চারা রোপণের উপযোগী হয়।
জমি প্রস্তুতি
ধান চাষের জন্য জমি ভালোভাবে প্রস্তুত করা জরুরি। জমি প্রস্তুতির জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে:
- জমি ৩-৪ বার চাষ দিতে হবে, যাতে মাটি ঝুরঝুরে হয়।
- চাষের আগে মাটিতে প্রয়োজনীয় জৈব সার মেশাতে হবে।
- জমি চাষের পর মই দিয়ে মাটি সমান করতে হবে।
চারা রোপণ
ধান চাষের জন্য বীজতলা থেকে চারা তুলে জমিতে রোপণ করা হয়। চারাগুলো সাধারণত ২০-২৫ সেন্টিমিটার লম্বা হলে রোপণ করা হয়। চারা রোপণের জন্য জমিতে প্রায় ৫ সেন্টিমিটার পানি থাকতে হবে।
চারা রোপণের পদ্ধতি:
- সাধারণত ২০-২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে চারা রোপণ করতে হবে।
- প্রতি জায়গায় ২-৩ টি চারা রাখতে হবে।
- রোপণের পর জমিতে পানি রাখতে হবে, যাতে চারা ঠিকভাবে বৃদ্ধি পায়।
সার প্রয়োগ
ধানের ভালো ফলনের জন্য সঠিকভাবে সার প্রয়োগ করা জরুরি। ধানের জন্য নাইট্রোজেন, ফসফরাস, এবং পটাশিয়াম সার সবচেয়ে প্রয়োজনীয়।
প্রাথমিক সার প্রয়োগ:
চারা রোপণের আগে জমিতে প্রতি হেক্টরে ১০-১২ টন গোবর সার, ১০০ কেজি ইউরিয়া, ৭০ কেজি টিএসপি, এবং ৫০ কেজি এমওপি সার মেশাতে হবে।
পরবর্তী সার প্রয়োগ:
- চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর প্রতি হেক্টরে ৪০ কেজি ইউরিয়া এবং ২০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
- ধানের বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে আবারও একই পরিমাণ ইউরিয়া সার দিতে হবে।
সেচ ব্যবস্থা
ধান চাষে সঠিক সেচ ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধান গাছ সব সময় পানি পছন্দ করে, তবে জমিতে অতিরিক্ত পানি জমে থাকলে গাছ পচে যেতে পারে।
সেচের সময়সূচি:
- চারা রোপণের পর প্রথম সেচ দিতে হবে।
- ধানের বয়স ২০-২৫ দিন হলে দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে।
- ধানের ফুল আসার সময় এবং দুধ অবস্থায় সেচ দেয়া খুবই জরুরি।
- ধান পাকার সময় পানি শুকিয়ে দিতে হবে।
আগাছা নিয়ন্ত্রণ
ধানের জমিতে আগাছা নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আগাছা মাটির পুষ্টি শোষণ করে ধান গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে।
আগাছা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি:
- চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর প্রথম আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
- দ্বিতীয় আগাছা পরিষ্কার করতে হবে ধানের বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে।
- আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য হার্বিসাইড ব্যবহার করা যেতে পারে।
পোকামাকড় ও রোগ নিয়ন্ত্রণ
ধান চাষে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও রোগ আক্রমণ করতে পারে। এদের মধ্যে কিছু প্রধান পোকামাকড় ও রোগ হলো:
১. বাদামী গাছফড়িং:
এই পোকা ধানের রস শোষণ করে গাছকে দুর্বল করে তোলে। গাছফড়িং নিয়ন্ত্রণের জন্য কীটনাশক স্প্রে করা হয়।
২. ধানের মাজরা পোকা:
এই পোকা ধানের কাণ্ডের ভিতর প্রবেশ করে এবং গাছের শাখা-প্রশাখা নষ্ট করে। মাজরা পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়।
৩. ব্লাস্ট রোগ:
ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত রোগ, যা ধানের পাতা ও কাণ্ডকে আক্রমণ করে। ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধের জন্য বীজ শোধন ও নিয়মিত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা উচিত।
ধান কাটা ও সংগ্রহ
ধান কাটার উপযুক্ত সময় হলো ধানের পাতা যখন হলুদ হয়ে যায় এবং ধান পাকার ৮০-৯০ শতাংশ হয়। ধান কাটার পর ধানকে ২-৩ দিন রোদে শুকাতে দিতে হবে, যাতে আর্দ্রতা কমে যায়।