জৈব বালাইনাশক তৈরি: চাষিদের জন্য সাশ্রয়ী সমাধান
এই গাইডে যা থাকছে:
- জৈব বালাইনাশক কী এবং কেন প্রয়োজন?
- বিভিন্ন প্রকার জৈব বালাইনাশক
- নিম, রসুন, লঙ্কা, আদা দিয়ে স্প্রে তৈরি
- ব্যবহারবিধি ও কার্যকারিতা
- কৃষকের জন্য ব্যবসার সুযোগ
জৈব বালাইনাশক কী এবং কেন প্রয়োজন?
বাংলাদেশের কৃষকদের এক বড় সমস্যা হলো জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার। এতে জমির উর্বরতা কমে যায়, ফসল বিষাক্ত হয় এবং কৃষকের খরচ বেড়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে জৈব বা প্রাকৃতিক বালাইনাশক একটি পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী সমাধান।
জৈব বালাইনাশক এমন একটি বিকল্প যা গাছের পোকামাকড় বা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে কিন্তু পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। এটি তৈরি হয় প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে যেমন: নিমপাতা, রসুন, লঙ্কা, তেতুল, কলার খোসা, ধনে, পেঁয়াজ, ইত্যাদি।
জৈব বালাইনাশকের প্রকারভেদ
নিচে কয়েকটি জনপ্রিয় জৈব বালাইনাশকের নাম ও উপাদান দেওয়া হলো:
নাম | উপাদান | পোকা দমন |
---|---|---|
নিম স্প্রে | নিমপাতা, পানি, সাবান | সাদা মাছি, চুষণকারী পোকা |
রসুন-লঙ্কা মিশ্রণ | রসুন, শুকনো লঙ্কা, পানি | ফলের মাছি, পাতাকাটা পোকা |
আদা ও কলার খোসা নির্যাস | আদা, কলার খোসা, গাঁজন | ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক |
তামাক নির্যাস স্প্রে | তামাকপাতা, পানি | ধসা ও পাতা বিঘ্নকারী |
নিম পাতার জৈব বালাইনাশক তৈরি পদ্ধতি

উপকরণ:
- নিমপাতা – ১ কেজি
- পানি – ৫ লিটার
- সাবান – ২০ গ্রাম
পদ্ধতি:
নিমপাতাগুলো ভালোভাবে ধুয়ে কেটে নিন। তারপর এগুলো একটি বালতিতে পানির সঙ্গে মিশিয়ে ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। পরদিন মিশ্রণটি ছেঁকে নিয়ে তাতে গলানো সাবান মিশিয়ে নিন। স্প্রে বোতলে ভরে গাছে স্প্রে করুন।
রসুন ও লঙ্কা স্প্রে

উপকরণ:
- রসুন – ১০০ গ্রাম
- শুকনো লঙ্কা – ৫০ গ্রাম
- পানি – ১ লিটার
পদ্ধতি:
রসুন ও লঙ্কা একসাথে বেটে নিন। এরপর ১ লিটার পানিতে সেই মিশ্রণ দিন এবং ৮ ঘণ্টা রেখে দিন। পরে ছেঁকে নিয়ে স্প্রে হিসেবে গাছে ব্যবহার করুন। এটি পাতাকাটা পোকা এবং ফলের মাছির বিরুদ্ধে কার্যকর।
জৈব বালাইনাশকের কার্যকারিতা ও ব্যবহার পদ্ধতি
স্প্রে করার সময় সকাল সকাল বা বিকেল বেলা স্প্রে করা ভালো। বেশি রোদে বা বৃষ্টির আগে স্প্রে করা উচিত নয়। প্রতি ৭ দিনে ১ বার স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
সতর্কতা:
- প্রতিটি স্প্রে ব্যবহারের আগে একটি ছোট গাছে পরীক্ষা করে নিন
- সঠিক অনুপাতে পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করুন
- ফসল কাটার ৫–৭ দিন আগে স্প্রে বন্ধ করুন
দুধ ও পানি মিশ্রণ স্প্রে

গরুর দুধ ও পানি ১:১ অনুপাতে মিশিয়ে স্প্রে করলে বিশেষ করে টমেটো, বেগুন জাতীয় গাছে পাতার পোকা, ছত্রাক, ও ভাইরাসের আক্রমণ কমে। এটি জৈব, নিরাপদ এবং অত্যন্ত কার্যকর একটি পদ্ধতি।
- দুধ – ১ লিটার
- পানি – ১ লিটার
ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে বোতলে ভরে পাতার উপর ও নিচে প্রয়োগ করুন। ৫–৭ দিন অন্তর প্রয়োগে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ধনে পাতার নির্যাস

ধনে পাতার গন্ধ অনেক পোকামাকড়ের জন্য বিরক্তিকর। এটি ছত্রাক ও পাতার দাগ রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর।
- ধনে পাতা – ২৫০ গ্রাম
- পানি – ২ লিটার
পেস্ট করে পানিতে মিশিয়ে ৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। ছেঁকে নিয়ে স্প্রে করুন।
ফল ও সবজি ফসলের জন্য উপযুক্ত জৈব বালাইনাশক
নিচে বিভিন্ন ফসল অনুযায়ী কার্যকর বালাইনাশকের তালিকা দেওয়া হলো:
ফসল | উপযুক্ত বালাইনাশক | ব্যবহারের সময় |
---|---|---|
টমেটো | রসুন-আদা-লঙ্কা মিশ্রণ | ৭ দিন অন্তর |
বেগুন | নিম স্প্রে | ৫ দিন অন্তর |
লাউ | ধনে পাতার নির্যাস | ৬ দিন অন্তর |
কুমড়া | দুধ+পানি স্প্রে | সপ্তাহে ১ বার |
জৈব বালাইনাশকের খরচ ও লাভ
জৈব বালাইনাশকের খরচ তুলনামূলক অনেক কম। নিচে একটি তুলনামূলক চিত্র দেওয়া হলো:
বালাইনাশক | খরচ (প্রতি লিটার) | বাজার মূল্য (লিটার) | সাশ্রয় |
---|---|---|---|
নিম স্প্রে | ২০ টাকা | ৬০ টাকা | ৪০ টাকা |
রসুন-লঙ্কা মিশ্রণ | ২৫ টাকা | ৭০ টাকা | ৪৫ টাকা |
দুধ-পানি স্প্রে | ৩০ টাকা | ৮০ টাকা | ৫০ টাকা |
সংরক্ষণ পদ্ধতি
জৈব বালাইনাশক দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় না। তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে ৫–৭ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়:
- বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করুন
- ঠান্ডা ও অন্ধকার স্থানে রাখুন
- ফ্রিজে রাখলে ১০ দিন পর্যন্ত ব্যবহার উপযোগী থাকে
কৃষকের বাস্তব অভিজ্ঞতা
নাম: রাজীব মোল্লা (দোহার, ঢাকা)
ফসল: বেগুন
অভিজ্ঞতা: “নিম ও রসুন মিশিয়ে বানানো স্প্রে দিয়ে আমি আমার ৩০ শতাংশ জমির বেগুন গাছ রক্ষা করেছি। খরচ কমেছে প্রায় ৭০% এবং পোকাও কমেছে। আমার প্রতিবেশীরাও এখন এই স্প্রে ব্যবহার করছে।”
জমির স্বাস্থ্য ও জৈব বালাইনাশক
জৈব বালাইনাশক ব্যবহার জমির স্বাস্থ্য ভালো রাখে:
- মাটির অণুজীব সক্রিয় থাকে
- পিএইচ ভারসাম্য ঠিক থাকে
- কেমিক্যালের চাপে মাটির জৈব শক্তি হারায় না
বাণিজ্যিক উৎপাদন ও আয়
গ্রামাঞ্চলে কৃষকেরা নিজের তৈরি বালাইনাশক স্থানীয় কৃষকদের কাছে বিক্রি করতে পারেন। নিচে একটি ছোট ব্যবসার হিসাব:
আইটেম | প্রতি লিটার খরচ | বিক্রয় মূল্য | লাভ |
---|---|---|---|
নিম স্প্রে | ২০ টাকা | ৫০ টাকা | ৩০ টাকা |
রসুন-লঙ্কা স্প্রে | ২৫ টাকা | ৬০ টাকা | ৩৫ টাকা |
সরকারি ও এনজিও সহায়তা
বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (DAE), BRAC, SHIREE সহ নানা প্রতিষ্ঠান জৈব কৃষি ও প্রাকৃতিক বালাইনাশক তৈরিতে কৃষকদের সহায়তা করে। প্রশিক্ষণ, লোন এবং পরামর্শ সুবিধা সহজলভ্য।
উপসংহার
জৈব বালাইনাশক ব্যবহার শুধু কৃষকের খরচ কমায় না, বরং ফসলকে নিরাপদ রাখে, মাটিকে সুস্থ রাখে, পরিবেশ রক্ষা করে এবং কৃষিকে টেকসই করে। চাষিরা নিজেরাই এই পদ্ধতি শিখে প্রয়োগ করতে পারেন, এবং একে পেশাদারি পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন।
নির্দেশনা:
- নিজের জন্য তৈরি করুন
- পাশের কৃষকদের শেখান
- ছোট ব্যবসা শুরু করুন