পরিবেশ ও মানব জীবন উন্নয়নে অপরিহার্য ভূমিকা
গাছ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা শুধু পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে না, বরং আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। গাছের প্রতি আমাদের সম্পর্ক সেই প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসছে, যখন মানুষ প্রথম বনজ সম্পদ ব্যবহার শুরু করে। আজকের আধুনিক যুগেও, গাছের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাছ শুধু পৃথিবীর সৌন্দর্য বাড়ায় না, এটি মানবজাতির জন্য খাদ্য, অক্সিজেন, ওষুধ, কাঠ, তেল, এবং এমনকি অর্থনৈতিক সহায়তাও প্রদান করে। এই নিবন্ধে গাছ লাগানোর বিভিন্ন উপকারিতা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।
১. পরিবেশ সুরক্ষা ও ভারসাম্য
গাছের প্রধান উপকারিতা হলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। পৃথিবীতে অক্সিজেনের পরিমাণ রক্ষা করতে গাছের ভূমিকা অপরিসীম। গাছের কাঁধে রয়েছে পৃথিবীকে শ্বাস নিতে সাহায্য করার গুরুতর দায়িত্ব। গাছেরা প্রক্রিয়াটি পদ্ধতিগতভাবে করেন, যার নাম “ফটোসিন্থেসিস”। এই প্রক্রিয়ায় গাছেরা সূর্যের আলো ব্যবহার করে কার্বন ডাইঅক্সাইডকে শোষণ করে এবং অক্সিজেন নির্গত করে। এই অক্সিজেন পৃথিবীর জীবজগতের জন্য অপরিহার্য।
গাছের পাতা, শাখা এবং শিকড় বায়ুপ্রবাহ শুদ্ধ করে, বায়ু দূষণ কমাতে সাহায্য করে, এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। বিশেষত, গাছ বায়ুর মধ্যে থাকা ক্ষতিকর গ্যাসগুলো যেমন নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, ও সালফেট কণিকা শোষণ করে। ফলে পরিবেশের গুণগত মান উন্নত হয় এবং বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব হয়।
এছাড়া, গাছ বৃষ্টির পানি শোষণ করেও ভূমিকার গুণগত মান বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বৃষ্টির সময় অতিরিক্ত পানি জমে না গিয়ে, মাটির মধ্যে শোষিত হয়ে স্থায়ী পানির সরবরাহ বজায় থাকে। গাছের শিকড় মাটি সুরক্ষিত রাখে এবং ভূমিক্ষয় রোধ করে। ফলে, ভূমির ক্ষয় কমানো, পাহাড়ী অঞ্চলে ভূমিধস ও নদীভাঙন রোধ করা সম্ভব হয়।
২. প্রাকৃতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুরক্ষা
গাছের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হলো এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করে। বিশেষত ঝড় বা প্রলয়ংকারী বৃষ্টির সময়, গাছের শিকড় মাটি ধরে রাখে এবং বায়ুপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। গাছেরা ভূমির ক্ষয় কমায় এবং পাহাড়ী এলাকা বা সমুদ্রসৈকতে মাটি সুরক্ষিত রাখে। এর মাধ্যমে ভূমিধস, বন্যা বা নদীভাঙন থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব কমানো সম্ভব।
এছাড়া, গাছের উপস্থিতি সাইক্লোন বা ঝড়ের সময় প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করে। গাছের পাতাগুলি, শাখাগুলি এবং গাছের আকার বাতাসের গতিবেগ কমাতে সাহায্য করে, এবং গাছের শিকড় মাটি আটকে রাখে, ফলে ঝড় বা প্রবল বৃষ্টির কারণে মাটি সরে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে।
৩. জীববৈচিত্র্য রক্ষা
গাছ বিভিন্ন জীবজন্তু এবং জীববৈচিত্র্যের বাসস্থান হিসেবে কাজ করে। গাছপালা কেবলমাত্র মানুষকেই নয়, হাজার হাজার প্রজাতির জীবজন্তু, পাখি, পোকামাকড়, এবং অন্যান্য প্রাণীকে আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহ করে। গাছপালায় পাখির বাসা তৈরি হয়, তাদের জন্য বাসস্থানের সুবিধা সৃষ্টি হয়। গাছের ফল, ফুল, পাতা, এবং গাছের শিকড়ে নানা ধরনের পোকামাকড় এবং অন্যান্য জীবজন্তু বাস করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে যে, যদি কোনো এলাকায় গাছ কম থাকে, তাহলে সেই এলাকায় জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হতে শুরু করে, কারণ প্রাণীদের খাবারের উৎস কমে যায়। বনাঞ্চল কমলে অনেক প্রজাতি তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। গাছের মাধ্যমে এই জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হয়, কারণ এটি প্রাকৃতিক খাদ্য চক্র বজায় রাখে।
৪. মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন
গাছের সাথে সম্পর্কিত থাকা শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে যে, গাছপালা দেখার মাধ্যমে মানুষ মানসিকভাবে প্রশান্তি অনুভব করে। গাছ এবং প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো, বিশেষ করে শহুরে পরিবেশে, মানুষের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। ছাদ বাগান, পার্ক বা বাগানে বসে থাকতে পারলে মনোযোগ ও উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়।
অধিকাংশ মানুষ যখন প্রকৃতির মধ্যে সময় কাটায়, তখন তাদের হরমোনের ভারসাম্য বজায় থাকে, বিশেষত স্ট্রেসের হরমোন কর্টিসোলের মাত্রা কমে যায়। এর ফলে উদ্বেগ ও চাপ কমে যায় এবং মানসিক শান্তি পাওয়া যায়।
৫. অর্থনৈতিক সুবিধা
গাছ লাগানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হলো অর্থনৈতিক সুবিধা। গাছ থেকে প্রাপ্ত পণ্য যেমন ফল, কাঠ, ওষুধ, রেজিন ইত্যাদি একটি অর্থনৈতিক উৎস হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, ফলের গাছ যেমন আম, জাম, পেয়ারা, আপেল, লিচু ইত্যাদি চাষ করে ব্যক্তিগত বা বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। গাছের কাঠ ও মশলা বিক্রি করে অর্থ আয় করা সম্ভব।
গাছের পাতা ও ফুল বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্মের জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে, যেমন পুঁতি, কাগজ, পেইন্টিং ইত্যাদি। এক্ষেত্রে গাছেরা শুধু জীবনধারণের জন্য খাদ্য সরবরাহ করে না, বরং অর্থনৈতিক সুরক্ষাও প্রদান করে।
৬. নগর পরিবেশ উন্নয়ন
নগর এলাকায় গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে যেখানে গাছের উপস্থিতি কম, সেখানে গাছ লাগানোর মাধ্যমে বাতাসের গুণগত মান উন্নত করা সম্ভব। গাছের শাখা এবং পাতা সূর্যের তাপ শোষণ করে, যা শহরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এই কারণেই শহরাঞ্চলে গাছ লাগানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাছাড়া, গাছ রাস্তাঘাট ও পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, যা শহরের মানুষের মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়। বসে থাকা, হাঁটা, বা হাঁটাহাঁটি করার সময় গাছের মধ্যে থাকলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই অনুভব করে শান্তি এবং প্রশান্তি।
৭. বিপদ রোধ ও খাদ্য নিরাপত্তা
গাছপালা মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানোর একটি কার্যকর উপায়। বিশেষত দেশের কৃষি ব্যবস্থা যেখানে অনেক সমস্যা বিরাজমান, সেখানে গাছ লাগানো বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উৎপাদনের উৎস হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মানুষ গাছের ফল, পাতা, বীজ ও শিকড় থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে। এটি বিশেষত শহুরে অঞ্চলে একটি শক্তিশালী খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করতে সাহায্য করে।
শহরে খাদ্যের উত্পাদন কমে যাওয়ার কারণে ছাদ বাগান এবং গৃহস্থালি বাগান এক ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য। এতে করে স্বাস্থ্যকর এবং রাসায়নিকমুক্ত খাদ্য পাওয়া যায় এবং পরিবেশের ক্ষতি ছাড়াই খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হয়।
৮. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা
গাছ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। গাছের মাধ্যমে, বিশেষ করে বনাঞ্চল বৃদ্ধি করার মাধ্যমে, আমরা পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করতে পারি। গাছেরা বাতাসের মধ্যে থাকা অতিরিক্ত কার্বন শোষণ করে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়া, গাছগুলো ভূমির তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে এবং মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা পরবর্তীতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কমাতে সক্ষম।
উপসংহার
গাছ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এর উপকারিতা অসীম। গাছ শুধু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে না, বরং মানব জীবনকে স্বাস্থ্যকর ও সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করে। গাছপালা আমাদের খাদ্য, অক্সিজেন, ঔষধ, আশ্রয়, এবং অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে