আমের বাণিজ্যিক চাষ পদ্ধতি এবং বাগান ব্যবস্থাপনায় আধুনিক কৌশল

ভূমিকা:

আম বিশ্বব্যাপী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফল, এর সুস্বাদু স্বাদ, গন্ধ এবং পুষ্টিগুণের জন্য এটি অন্যতম । এটি Anacardiaceae পরিবারের অন্তর্গত এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গ্রীষ্মমন্ডলীয়  অঞ্চলে চাষ করা হয়। আম চাষের সাথে লক্ষাধিক কৃষক জড়িত। এছাড়া ফল ব্যাবসার সাথে ও কৃষির মাদ্ধমে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। অধিক ফলন, উচ্চতর ফলের গুণমান এবং লাভ নিশ্চিত করার জন্য বাণিজ্যিক আম চাষের বিকল্প নেই। বাণিজ্যিক আম চাষের জন্য  সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক কৌশল প্রয়োগের প্রয়োজন। এই নিবন্ধটি আম বাগান ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত সমসাময়িক পদ্ধতি এবং কৌশলগুলি জানতে পারবেন, জমি নির্বাচন থেকে ফসল তোলার পর বাজারে নেওয়া পর্যন্ত যা প্রয়োজন তা জানতে পারবেন। 

জমি নির্বাচন এবং প্রস্তুতি:

আমের বাণিজ্যিক চাষ পদ্ধতি এবং বাগান ব্যবস্থাপনায় আধুনিক কৌশল

আম প্রায় যে কোন প্রকার মাটিতে জন্মে / চাষ করা যায়। এছাড়া আমগাছ টবে চাষ করা যায়। তবে আম চাষের জন্য গভীর মাটি প্রয়োজন। সাধারণত আম চাষের জন্য মাটি ২-৬ মিটার গভীর হওয়া প্রয়োজন এবং মাটি কিছুটা অম্লীয় হওয়া প্রয়োজন। মাটির অম্লতা বা ph মান ৫.৫-৭.০ আম চাষের জন্য সর্ব উত্তম। সফল আম চাষের জন্য সঠিক স্থান নির্বাচন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোত্তম জমি, ভাল-নিষ্কাশিত মাটি, সেচের ব্যাবস্থা এবং পর্যাপ্ত সূর্যের আলো রয়েছেএমন জমি নির্বাচন করতে হবে।  মাটি পরীক্ষা করে মাটির pH, পুষ্টির মাত্রা এবং টেক্সচার নির্ধারণ করে নিয়ে মাটি সংশোধন এবং নিষিক্তকরণ করতে হবে। আম বাগান করার জন্য উঁচু ও পানি সুনিষ্কাশিত জমি নির্বাচন করতে হবে। মাটির গঠন ও উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য সঠিক জমি প্রস্তুত করার জন্য জায়গা পরিষ্কার করা, লাঙল চাষ করা এবং জৈব সার যুক্ত করতে হবে। সেচের সুবিধার বিষয়ও নজর রাখতে হবে। আম বাগান টি যত সম্ভব বাজারের কাছে হলে ভালো হয়। যাতে করে বাগানের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী দ্রুত সংগ্রহ করা যায় এবং বাগানে উৎপাদিত ফল সংরক্ষণ ও বাজারজাত দ্রুত করা যায় আম চাষ বাগান আকারে করতে হলে প্রথমত নির্বাচিত জমি সমতল ও আগাছা মুক্ত করে করে নিতে হবে সেজন্য জমি চাষ ও মই দিতে হবে। জমিতে ইট পাথর , পুরাতন গাছের গোড়া এবং অন্যান্য জঞ্জাল থাকলে তা অপসারণ করে ফেলতে হবে। জমি এমন ভাবে তৈরি করতে হবে যেন সঠিক ভাবে গাছের শিকড় বৃদ্ধি হয় এবং খাদ্য উৎপাদন সহজলভ্য হয় 

আমের জাত নির্বাচন:

জলবায়ু, মাটির ধরন, বাজারের চাহিদা এবং রোগ প্রতিরোধের মতো বিষয় বিবেচনা করে উপযুক্ত আমের জাত নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

‘বাংলাদেশে আলফোনসো, ফজলি, হিমসাগর, খিরসাপাত, গোপালভোগ, মহনভোগ, ল্যাংড়া, আম্রপালি ইত্যাদি ‘-এর মতো জনপ্রিয় জাতগুলির  পরিবেশগত ভালো ফলন হয় এবং অনেক জনপ্রিয়তা রয়েছে।

কৃষকরা ফল পাড়ার সময় বাড়ানোর জন্য এবং দীর্ঘস্থায়ী বাজার ধরার জন্য জমিতে একাধিক জাত চাষের মিশ্রণ বেছে নিতে পারে।

আমের চারা রোপণের সময়: 

আমের বাণিজ্যিক চাষ পদ্ধতি এবং বাগান ব্যবস্থাপনায় আধুনিক কৌশল

আমের চারা রোপনের সঠিক সময় হলো বর্ষার শুরু বা শেষে। জমিতে যদি ভালো সেচ ব্যবস্থা থাকে তাহলে যে কোনো সময় আমগাছ লাগানো যায় তবে শীতকালে না লাগানোই ভালো। 

রোপণ প্রণালী : 

জমিতে রোপিত চারার পারস্পরিক অবস্থানই হলো রোপন প্রণালী। প্রতি একক জমিতে কতটি চারা লাগানো যাবে তা নির্ভর করে জমির আকৃতি, রোপণ দুরুত্ব ও রোপণ পদ্ধতির ওপর। বাগানে আম গাছ  আয়তাকার, ত্রিভূজাকার, বর্গাকার ও ষড়ভূজাকার পদ্ধতিতে রোপণ করা যেতে পারে। জমির আকার অনুযায়ী রোপনের আকার ঠিক করতে হয় তবে বর্গাকার পদ্ধতি আম বাগানের জন্য ভাল। আমের চারা রোপণের বিষয়ে রোপণ দূরত্ব একটি গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়। আম গাছ সাধারণতঃ ১২ মিটার বা প্রায় ৪০ ফুট দুরত্বে লাগাতে হয়। এই দুরত্বের গাছ লাগালে ৭০-৮০ বছর বা তার অধিককাল পর্যন্ত গাছে ভালো ফলন দেয় ও গাছ ভালো থাকে । তবে এখনকার সময় এ এসে ৩৫ বা ৩০ ফুট দুরত্বেও আম গাছ লাগানো হচেছ। আমাদের দেশের জাতগুলির মধ্যে প্রায় সবগুলির জাতের(লক্ষণ ভোগ ছাড়া) রোপণ দুরত্ব হালকা/নরম  মাটির জণ্য ৪০ ফুট এবং ভারি মাটি যেমন বরেন্দ মাটির জন্য ৩০ ফুট। লক্ষণ ভোগ (বারি-২) জাতের জন্য হালকা মাটির রোপন দূরত্ব ৩৫ ফুট এবং ভারী মাটির জন্য ২৫ ফুট। জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য রোপন দূরত্ব অর্ধেক করা যেতে পারে তবে খেয়াল রাখতে হবে যখনই গাছগুলি একে অন্যের সাথে লাগালাগি হলে সঠিক দূরত্ব রেখে অতিরিক্ত গাছগুলি কেটে ফেলতে হবে অথবা ডাল ছাটাই করে কয়েক বছর রেখে কেটে ফেলতে হবে। সঠিক দূরত্বে আমগাছ রোপন করলে ফলন বেশী পাওয়া যায় এবং ফলের গুণগত মান ভাল হয়। তবে খাটো জাতের আম যেমন বারি আম-৩ (আম্রপালী) এবং মল্লিকা  ৮-১০ মিটার দুরত্বে লাগানো যেতে পারে। ১২ মিটার দুরত্বে গাছ লাগালে প্রথম গাছটি বাগানের প্রান্ত থেকে রোপণ দুরত্বের অর্ধেক অর্থাৎ ৬ মিটার ভিতরে লাগাতে হবে। চারা রোপনের সময় খেয়াল রাখতে হবে চারা গাছের গোড়ায় যে পর্যন্ত মাটি আছে সে পর্যন্ত মাটিতে পুততে হবে। মাটিতে পোতার পর চারার গোড়ার মাটির চারপাশের মাটি ভালভাবে চেপে দিতে হবে যেন গাছটি নড়ে না যায়। রোপনের পর ৪৫ ডিগ্রী কোণে একটি বাঁশ দ্বারা ঠেকা দিতে হবে। চারা গাছের কান্ড বাঁশের সাথে এমন ভাবে বাঁধতে হবে যেন কান্ড বাঁশের সঙ্গে না লাগে এবং নড়তে না পারে।

বাগানে সেচ এবং পুষ্টি ব্যবস্থাপনা:

আম গাছের জন্য বাগানে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে যখন আমগাছে মুকুল আসে ও ফলে তৈরী হওয়ার পর্যায়ে। ড্রিপ সেচ ব্যবস্থা ভালো পানি ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করে, পানির অপচয় কমায় এবং এবং সঠিক পানি প্রদান নিশ্চিত করে। মাটির পুষ্টি বিশ্লেষণ এবং গাছের প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে মুকুল আসার পরে সুষম সার প্রয়োগ স্বাস্থ্যকর ফল বৃদ্ধি এবং উচ্চ ফলন পেতে সাহায্য করে।

বাগান ব্যবস্থাপনার আধুনিক কৌশল:

প্রযুক্তি এবং কৃষি পদ্ধতির উন্নতির ফলে বাগান ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু আধুনিক কৌশল গ্রহণ করা হয় যা ভালো বাগান তৈরী ও ফল উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করেছে। কিছু পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হলো। 

সমন্বিত কীটপতঙ্গ ও রোগ ব্যবস্থাপনা (IPM):

আইপিএম কৌশলগুলি কার্যকরভাবে কীটপতঙ্গ এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের সময় কীটনাশক ব্যবহার কমায়। জৈবিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, যেমন পোকা দমন করার জন্য ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা, লাইট ফাঁদ ও বিভিন্ন ফাঁদ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। 

আমের বাণিজ্যিক চাষ পদ্ধতি এবং বাগান ব্যবস্থাপনায় আধুনিক কৌশল

নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং কীটপতঙ্গ দমন এবং রোগের প্রাথমিক সনাক্তকরণ করে সময়মত হস্তক্ষেপ করার মাদ্ধমে ফসলের ক্ষতির ঝুঁকি কমিয়ে আনে। যার মাদ্ধমে ফলন উৎপাদনের হার অনেক বৃদ্ধি করা যায়। 

ছাউনি ছাঁটাই ব্যবস্থাপনা:

ছাঁটাই আম গাছের ছাউনিকে আকৃতি দেওয়ার জন্য  করা হয়। ফলে বাগানের মধ্যে ভাল আলোর এবং বায়ুপ্রবাহ উন্নতর করা হয়। ছাউনি ব্যবস্থাপনা গাছের আকার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে ফলে সহজে ফসল সংগ্রহ এবং কীটপতঙ্গ দমনে  সুবিধা পাওয়া যায়।

ফসল তোলার পর ব্যবস্থাপনা:

ফসল পাড়ার পরে ভুল ব্যবস্থাপনা আমের গুণমান এবং দীর্ঘদিন সতেজ রাখা সম্ভব হয় না। ফসল তোলার পরের আধুনিক প্রযুক্তি যেমন গরম পানির চিকিৎসা, নিয়ন্ত্রিত বায়ু সঞ্চালন এবং ইথিলিন গ্যাস ব্যবস্থাপনা ফলের সতেজতা ধরে রাখে এবং ফসল কাটার পরে ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে।

উপসংহার:

বাগান ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। নির্ভুল চাষ এবং সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে ফসল কাটার পরের উন্নত প্রযুক্তি পর্যন্ত। এই উদ্ভাবন আম শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। টেকসইতা এবং লাভজনকতা নিশ্চিত করার সাথে সাথে চাষীদের বাজারের চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে। আম চাষে অব্যাহত সাফল্য এবং বৃদ্ধির জন্য এই আধুনিক পদ্ধতিগুলি গ্রহণ করা অপরিহার্য।

শেয়ার করুনঃ