সুপারি বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে অন্যতম ফসল । প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশের মানুষ পানের সাথে অপরিহার্য উপাদান হিসেবে সুপারি ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সমুদ্র উপকূল এলাকাতে ও কিছু পরিমাণ সুপারির চাষ হয়ে থাকে।
উৎপত্তিঃ ভারত উপ-মহাদেশকেই সুপারির উৎপত্তিস্থল বলা হলেও বাণিজ্যিকভাবে প্রধানত বাংলাদেশ ও ভারতেই সুপারির চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে উৎপাদিত সুপারির ৯০% দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসমূহে জন্মে থাকে। সুপারি উৎপাদনের অন্যতম জেলাগুলো হলো বরিশাল, খুলনা এবং নোয়াখালী ইত্যাদি।
সুপারির ব্যবহারঃ পানের সাথে সুপারি খাওয়া ছাড়াও আহারের পরে অনেকেই মুখের স্বাধ ফিরে পাবার জন্য শুধু সুপারি খেয়ে থাকেন। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে প্রীতিভোজ শেষে পান সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন এর একটা রেওয়াজ আছে এবং বাড়িতে মেহমান এলেও পান, সুপারি দিয়ে আপ্যায়িত করা একটি সামাজিক শিষ্টাচার বলে অবিহিত। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রধানত পানের সাথেই সুপারী ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া বয়স্ক সুপারি গাছ বেড়া, চালা এবং খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সুপারি পাতাও বেড়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সুপারি গাছ বাড়ির শোভাবর্ধন ও বায়ু প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে।
সুপারির কিছু উন্নত জাতঃ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র থেকে এ পর্যন্ত ২টি উচ্চ ফলনশীল সুপারির জাত রয়েছে, যা বারি সুপারি-১ এবং বারি সুপারি-২ হিসেবে পরিচিত যা আমরা চিনি । তবে সুপারির উচ্চ ফলনশীল এই জাত গুলোর কিছু প্রয়জনের কারণে চাষিরা স্থানীয় জাতের সুপারি চাষ করে থাকেন। এগুলো আকারে ছোট এবং ফলন কম দেয়।
উপযুক্ত মাটিঃ আমাদের দেশে সুপারি চাষের জন্য উর্বর ও মাঝারী ধরনের মাটি অর্থাৎ হালকা উর্বর মাটি উত্তম, তবে বেলে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। মাটির পিএইচ মান ৫.৫-৬.০ এর মধ্যে হলে সবচেয়ে ভালো হয়।
সুপারির চারা উৎপাদন পদ্ধতিঃ সুপারির চারা উৎপাদনের জন্য প্রথমে উচ্চ মানের বীজ নির্বাচন করা উচিত। এই বীজগুলি উচ্চ মানের চারা উৎপাদনে সাহায্য করবে।সুপারির চারা উৎপাদনের জন্য সঠিক প্রকারে প্রস্তুত করা জমি গুরুত্বপূর্ণ। মাটি আকার, বীজের বোবা ও জমির পরিমাণ ঠিকমতো প্রস্তুত করা উচিত। বীজ বোবা করার সময় সঠিক দক্ষতা সহ বীজ বুআই করা উচিত। প্রতি বুআইতে একটি বীজ বোবা করা উচিত এবং তা উচ্চ মানের বীজ থেকে নেওয়া উচিত।চারা উৎপাদনের পরে চারা গুলির সঠিক যত্ন নেওয়া উচিত। সঠিক সেচ এবং সময়ে পোকামাকড় নির্ণয় করা উচিত।চারা গুলির সঠিক উপর দেখভালের জন্য পোকামাকড় ও অন্যান্য কীটনাশকের বিরুদ্ধে যত্ন নেওয়া উচিত। চারা গুলি প্রায় পুরোপুরি বিকাশের পরে সঠিক সময়ে সংগ্রহ করা উচিত।এই ধাপগুলি মনে রাখলে, সুপারির চারা উৎপাদন করা সহজ হবে এবং আপনি উচ্চ মানের চারা উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করতে পারবেন।
সুপারির বীজতলার জন্য মাটি নির্বাচনঃ সাদারন্ত দো-আঁশ, পলি দো-আঁশ মাটি বীজতলার জন্য উপযুক্ত মাটি । খোলামেলা, সেচের সুবিধা আছে এমন হালকা উর্বর মাটিতে বীজতলা করা উচিত। বীজতলার মাটিতে বালুর পরিমাণ কম থাকলে কিছু ভিটি বালু বা দো-আঁশ মাটি মিশিয়ে নিলে বেশি ভালো হয়। সুপারির বীজতলা আংশিক ছায়াযুক্ত হলে উত্তম হবে ।
- সুপারির জমি তৈরি ও সার প্রয়োগঃ প্রথমে জমির মাটি পরিশোধন করা উচিত। মাটি পরিশোধন এর মাধ্যমে পরিশোধিত বা প্রস্থত মাটি পেতে পারেন যা উপায়ে চারা উৎপাদন এবং বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।জমি প্রস্তুতির পরে কীটনাশক অ্যাপ্লিকেশন করা উচিত যাতে পোকামাকড় এবং অন্যান্য কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রিত থাকে।জমি প্রস্তুতি এর জন্য যথাযথ পরিমাণে সারের সরবরাহ করা উচিত। এটি প্রস্তুত হওয়া উচিত যাতে এটি চারা প্রবৃদ্ধি এবং উৎপাদন পেতে সাহায্য করে।
সার প্রয়োগ:
- নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম সার: সুপারির জমি তৈরি এবং চারা উৎপাদনের জন্য নাইট্রোজেন, ফসফরাস, এবং পটাশিয়ামের সার প্রয়োগ করা উচিত। এই সারগুলি উপযুক্ত অনুপাতে ব্যবহার করা উচিত যাতে প্রাকৃতিক উৎপাদন এবং জমির প্রকৃতিতে ভালো প্রভাব ফেলে।
- স্থানীয় সার সংশ্লিষ্ট সারের ব্যবহার: অনেকটি জমি প্রস্তুতি এবং সার প্রয়োগ এর জন্য স্থানীয় সার সংশ্লিষ্ট হতে পারে। এই সারগুলি জমির পরিস্থিতি এবং উৎপাদনের জন্য সঠিক অনুপাতে ব্যবহার করা উচিত।
বীজতলা তৈরিঃ প্রতিটি বীজতলা ১-১.৫ মিটার চওড়া এবং ৩ মিটার লম্বা হওয়া উচিত। বীজতলা উত্তর দক্ষিণে লম্বা হলে ভালো হয়। দুই বেডের মাঝখানে চলাফেলার জন্য দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বরাবর ৫০-৭৫ সেমি বা ২০-৩০ ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা রাখতে হয়। এরূপ ফাঁকা স্থানের মাটি তুলে নালা তৈরি করতে হবে এবং নালার মাটি বীজতলায় তুলে দিয়ে বীজতলাকে বেড আকারে ৬-৮ সেমি উঁচু করতে হবে। নালাগুলোর মধ্যে দিয়ে সেচ ও নিকাশের সুবিধা পাওয়া যায় এবং চারার পরিচর্যা করা সহজ হয়।
বীজ রোপণঃ বীজ সংগ্রহ করার পর দেরী না করে বীজতলায় বীজ রোপণ করতে হবে। বীজ রোপণের সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি বা ১২ ইঞ্চি এবং সুপারি লাগানোর সময় বীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ২০ সেমি বা ৮ ইঞ্চি। বীজ ১-২ সেমি. গভীরে এমনভাবে রোপণ করতে হবে যাতে বীজটি মাটির অল্প নিচে থাকে এবং বীজের উপরে মাটির একটা পাতলা আবরণ দিয়ে ধাকে দিতে না
রোপণ পরবর্তী যত্নঃ বীজতলায় বীজ রোপণের পরপরই উপরে ছায়া দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বীজতলা খুড়কুটো বা কচুরীপানা দিয়ে ঢেকে রেখে অর্থাৎ মালচিং করে মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখা দরকার। বীজতলা ইস্থানে সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে এবং অবশ্যই বেড়ার বা নেটের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে গরু ছাগল চারা নষ্ট না করতে পারে ইত্যাদি।
ভালো চারা বাছাইঃ বীজ লাগানোর পর তিন মাসের মধ্যে যে সকল বীজ গজায় সেগুলো থেকে ভালো চারা পাওয়া যায়। বীজ রোপণের পর সে সকল চারা তাড়াতাড়ি গজায়, দ্রুত বাড়ে, গোড়া মোটা হয়, পাতা ও শিকড় বেশি হয় এসব চারা বাছাই করা উত্তম। চারার বয়স ৬ মাস হলেই বাগানের লাগানো যায়। তবে ১২-১৮ মাস বয়সের চারা, যেগুলো খাটো ও মোটা এবং কমপক্ষে ৫-৬টি পাতা থাকে এমন ধরনের চারা মাঠে লাগানোর জন্য বাছাই করা দরকার।
জমি নির্বাচনঃ সাধারণত আমাদের দেশে প্রায় সব বসতবাড়ির আশেপাশে, পুকুর পাড়ে, স্কুল-কলেজের রাস্তার ধারে বা নদীর আঙিনায় সুপারি গাছ লাগানো হয়। তবে সুপারি বাগান করতে চাইলে বাগানের জমি সঠিকভাবে নির্বাচন করতে হবে। যেটি সুনিষ্কাশিত, উর্বর, সামান্য ছায়াযুক্ত, প্রবল বাতাস প্রতিরোধী এবং উঁচু জমি বাগানের জন্য নির্বাচন করতে হবে। জমি নির্বাচন করতে হবে যাতে জমিতে জলাবদ্ধতা না হয়।
জমি তৈরি এবং চারা রোপণঃ ছোট অবস্থায় সুপারি গাছ তীব্র বাতাস এবং প্রখর সূর্যালোক সহ্য করতে পারে না। কাজেই সুপারির চারা মাঠে লাগানোর পূর্বেই রোপণ করতে হবে। সুপারির চারা সাধারণত মাদা তৈরি করে লাগানো হয়। মাদার আকার ৭০ সেমি. x ৭০ সেমি. x ৭০ সেমি হলে ভালো হয়। মাদা তৈরি করার সময় উপরের মাটি একদিকে এবং নিচের মাটি অন্যদিকে আলাদা করে রাখতে হবে। গর্তের ভেতরটা শুকনো পাতা, খড় এসব দিয়ে ভরাট করে গর্তটা শোধন কোরতে হবে ।
প্রতিটি গর্তের জন্যে ১০ কেজি পচা গোবর বা কম্পোস্ট এবং ১ কেজি খৈল গর্তের উপরের অর্ধেক মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্তের তিন-চতুর্থাংশ ঐ মাটি দ্বারা ভরে ফেলতে হবে। সাধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। তবে জুন-জুলাই মাস চারা রোপণের জন্য উত্তম। মাদার দূরত্ব অর্থাৎ চারার দূরত্ব বর্গাকার পদ্ধতিতে ৩.৫ হাত এবং আয়াতাকার পদ্ধতিতে লাইন থেকে লাইন প্রাই ৬ হাত এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৩.৫ হাত হবে ।
অর্ন্তবর্তীকালীন পরিচর্যাঃ চারা রোপণের পর বিভিন্ন ধরনের অর্ন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা প্রয়োজন। যেমনঃ
আগাছা পরিষ্কারঃ গাছের গোড়া সব সময়ই আগাছামুক্ত রাখা প্রয়োজন। বর্ষাকালে আগাছা বেশি হয় বিধায় ঘন ঘন আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। সার ও সেচ দেয়ার আগে অবশ্যই আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দেওয়াঃ গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। সেচ ও সার প্রয়োগ এবং বৃষ্টিপাতের ফলে গাছের গোড়ার মাটি সরে যায় এবং শিকড় বের হয়ে পড়ে। এজন্যই গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হয়। এছাড়াও গাছের গোড়ায় জলাবদ্ধতা এড়াতে মাটি তুলে দেওয়া প্রয়োজন।
সেচ ও নিকাশঃ সুপারি চাষে সেচ ও নিকাশের গুরুত্ব অপরিসীম। সুপারি কিছুটা আর্দ্র মাটিতে ভালো হয় বিধায় মাটিতে রসের অভাব হলেই সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। শুকনো মৌসুমে মাটির প্রকারভেদে ৫-১০ দিন পরপর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। সুপারি যেমন আর্দ্রতা পছন্দ করে আবার জলাবদ্ধতাও এর জন্য ক্ষতিকর। তাই সেচের পাশা পাশি পানি নিকাশেরও ব্যবস্থা নিতে হবে।
সার প্রয়োগঃ সুপারি গাছে রাসায়নিক সার ২ ভাগে ভাগ করে বছরে ২ বার গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে (প্রথমবার সেপ্টেম্বর মাসে এবং ২য় বার ফেব্রুয়ারি মাসে দিতে হয়)।
সুপারি গাছ থেকে ভালো ফলন পেতে গাছের বয়স প্রথম বছর হলে প্রতি গাছের জন্য প্রায় ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি সার দুই ভাগ করে এক ভাগ বৈশাখ ও জৈষ্ঠ মাসে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক সার ভাদ্রও আশ্বিন মাসে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স দুই বছর হলে ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ২০০ গ্রাম এমওপি একই ভাবে দুইভাগ করে একভাগ মৌসুমে অপর অংশ বর্ষায় প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স তিন বছর হলে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫০ গ্রাম এমওপি সার একইভাবে দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ৪-১০ বছর হলে ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৩০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৩০০ গ্রাম এমওপি সার অনুরূপভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
সুপারি গাছে মুচি আসার আগে অর্থাৎ মধ্য চৈত্র থেকে মধ্য বৈশাখ এর মধ্যে গাছের গোড়ার চারিদিকে ১.৫-২ ফুট দুরত্বে এক ফুট চওড়া ও ৬ ইঞ্চি গভীর করে মাটি সরিয়ে ফেলতে হবে। পরে ওই মাটির সাথে ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৪৫০ গ্রাম টিএসপি৬৫০গ্রাম এমওপি, ৩০০ গ্রাম ও জিপসাম এবং ১০০ গ্রাম জিংক মাটির সাথে ভালো ভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। মিশ্রিত সার সুপারি গাছে ওই গতে মাটি দিয়ে পুনরায় সার দিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে।
রোগ বালাই ব্যবস্থাপনাঃ সুপারি গাছ ও ফল বিভিন্ন প্রকার রোগ পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে । তাই আপনি ভালো ফলন পেতে হলে রোগবালাই ব্যবস্থাপনা একান্ত অপরিহার্য। প্রধান কিছু রোগবালাই এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নিচে বর্ণনা করা হলো।
ফল পচা রোগঃ রোগের আক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত সুপারির বোঁটায় পানি ভেজা ছোপ ছোপ দাগ পড়ে এবং আস্তে আস্তে অনেকগুলো দাগ একত্রে মিশে বড় আকার ধারণ করে। আক্রান্ত স্থান ক্রমান্বয়ে বাদামী ও ছাই রঙের হয়ে এক সময়ে পুরো সুপারিটাই রোগাক্রান্ত হয়ে পচে ঝরে পড়ে।
প্রতিকার ব্যবস্থাঃ এ রোগ দমনের জন্যে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের শুরুতেই সুপারির ছড়ায় ও পাতায় ১% ‘বোর্দো মিক্সার’ অথবা ১.৫% হারে ম্যাকুপ্রাক্স নামক ছত্রানাশক রোগের তীব্রতা অনুযায়ী ১৫-৩০ দিন পর পর ৩/৪ বার গাছে স্প্রে করতে হবে। আক্রান্ত গাছের সুপারি ছড়াসহ পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং গোড়ায় পানি জমে থাকলে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
কুঁড়ি পচা রোগঃ এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ ক্ষেত্রে ছত্রাক জীবাণু মোচার গোড়ায় কাণ্ডের সংযোগ স্থলের নরম টিস্যু আক্রমণ করে। আক্রান্ত স্থানের টিস্যু প্রথমে হলুদ ও পরবর্তীতে বাদামী রঙ ধারণ করে এবং শেষ পর্যায়ে পচে কালো হয়ে কুঁড়িগুলো ঝরে পড়ে।
প্রতিকারঃ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই আক্রান্ত স্থান চেছে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু পরিষ্কার করে ‘বোর্দো পেস্ট’ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত স্থান ব্যান্ডেজ করে দিতে হবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গাছের পাতা ও মোছায় ১% বোর্দো মিক্সার অথবা ১.৫% কুপ্রাভিট ১৫-২০ দিন অন্তর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে। মৃত গাছ, ফলপচা রোগে আক্রান্ত মোচা ও ফল সরিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে এবং বাগানের সমস্ত গাছে ১% বোর্দো মিক্সার অথবা কুপ্রাভিট স্প্রে করে সকল গাছ ভিজিয়ে দিতে হবে।
মোচা শুকিয়ে যাওয়া ও কুড়ি ঝরাঃ এ রোগটি প্রধানত গ্রীষ্মকালে হয়ে থাকে। রোগের আক্রমণে আক্রান্ত মোছার গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত হলুদ হয়ে যায়, পরবর্তীতে গাঢ় বাদামী রঙ ধারণ করে এবং পুরো মোচাটি শুকিয়ে যায়। ফলে আক্রান্ত মোচার কুঁড়িগুলো ঝরে পড়ে।
প্রতিকারঃ আক্রান্ত গাছের মোচা কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই ‘ডায়থেন এম-৪৫ অথবা নোইন নামক ছত্রানাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ চা চামচ হিসেবে গাছে মোনা বের হলেই ১৫ দিন পরপর ৪-৫ বার স্প্রে করতে হবে।
মাকড়ঃ সুপারি গাছ কয়েক ধরনের মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয় যেমনঃ লাল মাকড়, সাদা মাকড়, হলদে মাকড়। সকল বয়সের সুপারি গাছেই লাল ও সাদা মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ পোকা পাতার রস চুষে খায়। ফলে আক্রান্ত পাতা প্রথমে হলুদ ও পরে তামাটে রঙ ধারণ করে এবং পরিশেষে শুকিয়ে যায়। আস্তে আস্তে পুরো পাতাই শুকিয়ে যায়, গাছ নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং মারা যায়।
প্রতিকার ব্যবস্থাঃ মাকড় দমনের জন্য কোরনিয় ১০ লিটার পানিতে ৫ চা চামচ ‘ক্যালথেন’ নামক মাকড়নাশক সুপারি গাছের পাতার নিচের দিকে প্রায় ১৫-২০ দিন পরপর ৩-৪ বার সুপারি গাছে স্প্রে করতে হবে।
মোচার লেদা পোকা : এ পোকার মথ কচি মোচায় ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে ক্রীড়া বের হয়ে অফুটন্ত মোচার ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং মোচার মধ্যে কচি-ফুলগুলো খেতে থাকে এবং মল ত্যাগ করে সম্পূর্ণ মোছাটাকেই পূর্ণ করে ফেলে। আক্রান্ত মোচায় ফুল আসে না এবং মোচাটিও ফুটে না।
প্রতিকারঃ আক্রান্ত মোচা সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত গাছসহ সকল গাছে ১০ লিটার পানির সঙ্গে ৬ চা চামচ সুমিথিয়ন মিশিয়ে ১৫-২০ দিন পরপর ২-৩ বার মোচায় স্প্রে করতে হবে।
শিঁকড়ের পোকাঃ এ পোকার কীড়া বা বাচ্চা গাছের শিকড়ে আক্রমণ করে। এরা প্রথমে গাছের কচি ও নরম শিকড় খেতে শুরু করে। অতঃপর গাছের শক্ত ও পুরানো শিকড় খেয়ে ফেলে। ফলে পাতা হলুদ হয়ে যায়, উপরের কাণ্ড চিকন হয়ে আসে এবং ফলন কমে যায়।
প্রতিকারঃ এ পোকার আক্রমণের লক্ষণ দেখা দিলেই গাছের চারপাশে ১ মিটার ব্যসার্ধে হালকা করে কুপিয়ে বাসুডিন ১০ কেজি অথবা ফুরাটার ৩জি গাছ প্রতি ১০ গ্রাম হারে ছিটিয়ে পানি সেচ দিতে হবে এবং মালচিং করে দিতে হবে। বছরে দু’বার অর্থাৎ বর্ষার আগে ও পরে এভাবে মালচিং করে দিতে হবে। তাহলে এ পোকার আক্রমণ থেকে গাছকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
ফসল সংগ্রহঃ সুপারির চারা লাগানোর পর সঠিকভাবে যত্ন নিলে ৪-৫ বছরের মধ্যেই ফলন আসতে শুরু করে। গাছে ফুল আসার পর থেকে ফল পাকতে ৯-১০ মাস বয়স লাগে। ফল সংগ্রহের সময়ে সুপারি ছড়াগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে নামাতে হবে। সুপারি পরিপূর্ণভাবে পাকা, আধাপাকা, অথবা পরিপক্ব কাঁচা অবস্থায় সংগ্রহ করা যায়। উল্লেখ্য যে, সুপারি সংগ্রহ নির্ভর করে তা কিভাবে ব্যবহার করা হবে বা প্রক্রিয়াজাত করা হবে তার ওপর।
ফলনঃ বিভিন্ন এলাকা ভেদে বিভিন্ন স্থানের ফলনে পার্থক্য রয়েছে। জাতের বিভিন্নতা, পরিচর্যা, গাছের বয়স ও জলবায়ুর প্রভাব এসব কারণগুলো এর জন্য দায়ী। সাধারণত সুপারি গাছ সাধারন্তো ১০-৪০ বছর পর্যন্ত সর্বোচ্চ ফলন দিয় থাকে।